সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারত গমন : স্বরূপ সন্ধান : যৌক্তিকতা আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে Part - ৮ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ১৪ ]


উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, অবৈধ অভিবাসীজনিত সমস্যা কেবল ভারতের নয়, যার ভুক্তভোগি বাংলাদেশও। এ ধারা থেমে যায়নি, থেমে থাকবে না কখনো্। কারণ সীমান্তে গুলি করার পরও নানা কারণে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দেয়। তবে সব ক্ষেত্রে অভিবাসী হওয়া খারাপ তা কিন্তু বলা যাবে না। অনেক বাংলাদেশি ইউরোপ আমেরিকাতে অভিবাসী হয়েছে, যাদের বর্তমান কয়েকজনের পরিচয় তুলে ধরা হলো উদাহরণ হিসেবে।
:
হ্যানসেন ক্লার্ক, আনোয়ার চৌধুরী, সালমান খান, লুৎফর রহমান, রোশনারা আলী, মনজিলা পলা উদ্দিন, সায়রা খান- এরকম একগুচ্ছ নাম। তারা বিদেশ বিভুইয়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। কেউ যুক্তরাষ্ট্রে, কেউ বৃটেনে, কেউ নরওয়েতে- এভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন অনেক বাংলাদেশী। তাদের কারণে বিদেশের বুকে বাংলাদেশ ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। প্রথমেই বৃটেনে বসবাসরত কৃতী বাংলাদেশীদের প্রসঙ্গ। বৃটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদেরকে বৃটিশ বাংলাদেশী বলা হয়ে থাকে। এরা বাংলাদশে থেকে অভিবাসী হয়ে বৃটেনে গেছেন। এরপর সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এরা বৃটিশ বাঙালি বলেও পরিচিত। বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ অভিবাসী হয়ে বৃটেনে পাড়ি জমালেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিলেট জেলার লোকজনই সেখানে বেশি অভিবাসী হয়েছেন।
:
টাওয়ার হ্যামলেটে অভিবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। লন্ডনে বাংলাদেশীদের অবস্থানের কারণে সেখানকার বাংলাদেশীদেরকে লন্ডনি বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বৃটেনের বার্মিংহাম, ওল্ডহাম, লুটন এবং ব্রাডফোর্ডেও বাংলাদেশীদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। ম্যানচেস্টার, নিউক্যাসল, রোচডেল, কারডিফ এবং সান্ডারল্যান্ডের গুটি কয়েক বাংলাদেশীর উপস্থিতি রয়েছে। বৃটেনে যেসব দেশের অভিবাসীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যুক্তরাজ্যের ২০০১ সালের জনসংখ্যা জরিপে দেখা গিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সংখ্যা ১৫,৪,৩৬২ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২,৮৩,০৬৩ জনে। ২০০৭ সাল নাগাদ কেবল ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৫৩,৯০০ জনে। এখন ধারণা করা হয়, বৃটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা ৫,০০,০০০। ২০০৬ সালের বৃটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে বসবাসকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩,৩৮,৩০০ জন। তবে ধারণা করা হয়, বৃটেনে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশী রয়েছেন। 
:
সালমান খান। না, বলিউডের অভিনেতা সালমান খান নন। তিনি বাংলাদেশী বংশোদভূত মার্কিনি। টাইম ম্যাগাজিন নির্বাচিত বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি অনলাইন ফ্রি লাইব্রেরি খুলে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তার লাইব্রেরির নাম দিয়েছেন খান একাডেমি। এই খান একাডেমিই তাকে এনে দিয়েছে জগতজোড়া খ্যাতি। তার জন্ম ১৯৭৬ সালে। এ বছরের জুলাই মাসেই ইউটিউবের মাধ্যমে তার খান একাডেমি চ্যানেলে ঢুঁ মেরেছেন ৩ লাখ ৫৫ হাজার দর্শনার্থী। সালমান খানের জন্ম লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্সে। তার পিতার আদি নিবাস বরিশালে। সালমানের মা কলকাতার। 
:
নরওয়েতে খ্যাতি কুড়িয়েছেন বাংলাদেশী সায়রা খান। তিনিই প্রথম নরওয়ের পার্লামেন্টের বাংলাদেশী সদস্য। তিনি লেবার পার্টি থেকে ২০০৫ সালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। নোবেল জয়ী মোহাম্মদ ইউনুসের বড় কন্যা মনিকা ইউনুসের জন্ম ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামে। বাংলাদেশি-রাশিয়ান-আমেরিকান মনিকা বিশ্বের প্রখ্যাত সব অপেরাতে সঙ্গীত পরিবেশনকারি হিসেবে বিশেষ ভাবে খ্যাত। ড. ইউনুসের সাবেক স্ত্রী ভেরা ফরোসটেনকোর কন্যা মনিকার আরেকজন সৎবোন রয়েছে দিনা ইউনুস।
:
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীতে প্রথম বাংলাদেশী ইমাম আবু হেনা সাইফুল ইসলাম। তার জন্ম ১৯৬৩ সালে। জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশী। উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পড়াশোনা করেন সাউদার্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৯২ সালে অর্জন করেন এমবিএ ডিগ্রি। একই বছর তিনি যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কোরে। আগেভাগেই তিনি ডিভি লটারিতে আবেদন করেছিলেন। তাকে ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেয়া হয়।
:
এ তালিকা দীর্ঘ করে আর লাভ নেই। এবার লেখার ইতি টানতে হবে। ফিরতে চাই মূল কথায়।
:
বাংলাদেশ থেকে যেসব অসহায় হিন্দু ভারতে পাড়ি জমায় তাদের অধিকাংশের বসবাসের ভাগ্য জোটে বস্তি অথবা রেল লাইনে ধারে। অনেক সম্পদশালী পরিবারকেও ভারতে গিয়ে দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। সব হিন্দুই যে অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছাড়ে তা কিন্তু নয়, অনেকেই আছে যারা আগাম আক্রমণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালায় কিন্তু মনে করে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত তাদের উন্নততর জীবনের নিশ্চয়তা দেবে! এই ভারত পলায়নের কারণে হিন্দুরা পরোক্ষভাবে কতোটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ বিষয়ে অনেকের ধারণা নেই। দেশের হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা আশঙ্কাজনক ভাবে হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণও এটি। আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু ১৯৭১ এর পরে যদি এই বিশাল অঙ্কের হিন্দুরা ভারতে পাড়ি না জমাতো তবে আজ হয়তো তারা ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। আজ ভারতে মুসলমানরা একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে, কারণ তারা সেক্যুলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর কারণে সহজেই নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। ২০০২ সালে ভারতের গুজরাট দাঙ্গায় কয়েক লাখ মুসলমান গুজরাট ছাড়া হয়েছিল। কিন্তু তারা দেশ ছেড়ে পালায়নি বরং নির্দিষ্ট এক এলাকায় জড়ো হয়ে একজোট হয়েছিল, বাংলাদেশ বা সৌদি আরব চলে যায়নি। 
:
বাংলাদেশের যেসব এলাকায় বেশি হিন্দু নির্যাতন হয় তারা পারে দেশ না ছেড়ে নির্দিষ্ট একটি এলাকা জুড়ে একজোট হতে । ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পুর্বপুরুষেরা বাংলাদেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। ১ কোটি বাঙালী যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সকলে দেশে ফিরে এসেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে হিন্দুদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল । সুতরাং সবার অধিকার আছে এদেশের মাটিতে থাকার। তাদের বাবা দাদুরা পালিয়ে না গিয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করেছেন তবে এরা কেন সামান্যতেই কাপুরুষের মতো দেশ ছেড়ে পালাবে? আপনি নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলেন মানে স্বার্থপরের মতো আপনার দুই কোটি হিন্দু ভাইদের বিপদ বাড়ালেন। সেই সাথে স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে হেরে গিয়ে তাদের স্বপ্ন পূরণ করলেন। বরং প্রতিজ্ঞা করুন, যতো কষ্টই হোক না কেন রক্ত দিয়ে অর্জিত মাতৃভূমি ছাড়বেন না। ভেগে যাওয়ার সময় ফুরিয়ে এসেছে, এবার জেগে ওঠার পালা।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন