মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ৪ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ১৯]

এর পরপরই ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনি মিলিতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং পাকবাহিনি বিভিন্ন রনাঙ্গণে পরাজিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতিয় অনেক সৈন্যও শহীদ হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও অগণিত মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ আমরা বিজয় অর্জন করি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পাশে ছিলেন ভারতিয় জনগণ ও সরকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা অর্পণ না করে নজিরবিহীন সেনা অভিযান শুরু করে। বাঙালিদের ওপর আক্রমণের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু তার পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সেই বার্তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এর পরপরই পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল ধানমন্ডির বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।
মে মাসের শুরু থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এ সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। যার কারণে ভারতিয় সরকার পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই সময় ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলকে সমর্থন দিতে থাকে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ সময় ভারত পূর্ববাংলার সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতিয় সেনাবাহিনির একটি দল পূর্ববাংলায় মোতায়েন করা হয়। ভারত কর্তৃক প্রেরিত তিনটি সৈন্যবহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক, একটি ছিল নবম পদাতিক, যাদের ভারত পূর্ববাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সমর্থনদানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কার্যকর কূটনীতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে প্রচুর সাহায্য করেছে- এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের দেশে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে সেনা সহায়তা দেয়াসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ দিয়েছিল ভারত। ভারতের সামরিক বাহিনির সহায়তায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনিকে স্পষ্টভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। আর পাকিস্তানি বাহিনি আত্দসমর্পণের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে ভারত রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও মতাদর্শগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে।
ভুটানের পর দ্বিতীয় বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারত-বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে পূর্ণ বিজয় অর্জনের ১০ দিন আগেই ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওইদিন একটি চিঠি দিয়েছিলেন মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানান এবং ভারতের পার্লামেন্টে ওইদিন সকালে এ বিষয়ে তার বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর সেই চিঠি স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিনগুলোয় মুজিবনগর সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা জুগিয়েছিল। ইন্দিরার সেই চিঠির দিকে চোখ বুলালেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বোঝা যায়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন