মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ১০ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২৫ ]



এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরও আমাদের মনের গহিন কোণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জট পাকিয়ে এখনো বসে আছে। অনেকটা কিঞ্চিৎ ধোঁয়াটে আর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শত্রু-মিত্রদের চেহারা অনেকটা আবছা আয়নায় যে যার মতো করে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাতে শুধু উপযুক্ত ‘তথ্য ও উপাত্তে’র অভাবে অনেক জানা তথ্যও ইতিহাসের পাতায় আমাদের কাছে নিরন্তর অজানাই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ একদিনের কোনো ফসল নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি পশ্চিমিদের বৈষম্যমূলক আচরণ তো বটেই, সেইসঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানাবিধ কূটনৈতিক চাল ও প্রত্যক্ষ রাজনীতির মুষ্টিতে আবদ্ধ ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সে-কারণেই খুব স্বাভাবিকভাবেই হাসান ফেরদৌসের উৎসাহী কলম মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতিগত অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের ভূমিকাগুলো খুব যত্নের সঙ্গে যথাযথ তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত মানুষের পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। 
:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বন্ধুত্বের সঙ্গে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কতটুকু জড়িত ছিল, সে নিয়েও তাদের চিন্তা ছিল বইকি? এদিকে ভারত যাতে সহসাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, সেদিকেও সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখ খোলা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা অভিযানের তীব্র সমালোচনা করলেও সামরিকভাবে এ-সংকটে জড়াতে সে মোটেও আগ্রহী ছিল না। ভারত যাতে শিগগির কোনো সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ে, সে-ব্যাপারেও দিল্লির নেতাদের পরামর্শ দেয় মস্কো। সোভিয়েতের এই দ্বিধান্বিত পদক্ষেপের কারণ, সে খুব ভালো করেই জানত। চীনকে নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যে এক দশক ধরে পাকিস্তান ও ভারতকে নিয়ে যে যৌথ নিরাপত্তা-ব্যবস্থার পরিকল্পনা সে করে আসছিল, ভবিষ্যৎ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কোনো এক পক্ষকে সমর্থনের অর্থ হবে তার সে-পরিকল্পনার নিশ্চিত সমাপ্তি।’ 
:
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা ১৯৭১ সালের ১ জুন সে-কথারই যেন এক আভাস দেয়। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অব্যাহত রক্তপাতের ফলে শুধু যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে তা নয়, সমগ্র এশিয়ার তথা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’ এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এ-যুদ্ধকে কোনোভাবেই সহজভাবে নিতে চায়নি। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, গোটা এশিয়া মহাদেশেও সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা বিস্তারের কৌশল স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র সর্বান্তঃকরণে চেয়েছিল পাকিস্তান যুদ্ধে জিতুক এবং এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রসারিত হোক। লেখকের দাবি, ‘যুদ্ধে বিপর্যয় অনিবার্য জেনেও সে-যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পীড়াপীড়ি করছিলেন এই যুক্তিতে যে, তাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র পাকিস্তান নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে জেনেও আমেরিকা যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তার ফলে নতুন মিত্র চীন আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে দ্বিধা করবে। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানকে সরাসরি মদদ জুগিয়েছিল। চীন ও আমেরিকার পাঠানো অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনি বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করে। রক্তস্নাত সেই নয় মাসে কখনোই একবারের জন্যও তারা সেই গণহত্যার নিন্দা করেনি। আমরা এও দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র আণবিক রণতরি পাঠিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে সন্ত্রস্ত করতেও দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে মস্কো ভারতকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাও ভারতের মাধ্যমে সেই অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল। 
:
একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে সরাসরি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সেক্টরে যুদ্ধে নামে। পাকিস্তানের মত একটি ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন ও চীনের সহায়তাপুষ্ট শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ভারতের কি কোন ক্ষতি হয় নি? আমাদের জানা ও বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে এ যুদ্ধে (বাংলাদেশ যুদ্ধে) ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট কত সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছিল? যার আর্থিক মূল্য কত? মানুষ ছাড়াও এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত অস্ত্র, বিমান, নৌ-জাহাজ ইত্যাদির পরিমাণ ও তার আর্থিক মূল্যমান কি আমরা বলতে পারবো? যুদ্ধে ভারতের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কি খুব নগণ্য ছিল?
:
ভারত ছাড়াও এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রকারে আমাদের সহায়তা দিয়েছিল? মানে অস্ত্র, অর্থ, কূটনৈতিক কিংবা অন্য আর কি কি ভাবে? স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী গঠনে ভারত কি কি বিমান ও নৌযান বাংলাদেশকে দান করেছিল, তাও প্রকাশিত হওয়া দরকার সত্য ইতিহাস সামনে আনার প্রয়াসে। আরো জানা দরকার, আত্মসমর্পনের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করার লক্ষে, পাকিস্তান নৌবাহিনী কর্তৃক পুরো বঙ্গোপসাগরে ‘অসংখ্য ভাসমান মাইন’ ছড়িয়ে দেয়ার গল্প এবং স্বাধীনতার পর তা উদ্ধারে এসে মাইন বিস্ফোরণে সৌভিয়েত নাবিকদের পতেঙ্গা সৈকতে নির্মম নিহত হওয়ার কাহিনি। নিহত এ সোভিয়েত সৈনিকরা হয়তো জন্ম নিয়েছিল লেনিনগ্রাদ বা ভারখয়োনস্কের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে, যারা অন্য এক অচেনা জাতির ‘মুক্তি সংগ্রামে’ এসে নিজের জীবনটি দান করলেন পতেঙ্গা সৈকতে! এদের সাহসের গল্প আমাদের না শোনালে, এ বীরত্বের কাহিনি আমাদের না জানালে, এদের স্মৃতিতে স্মৃতিশৌধ আমরা না বানালে, এদের আত্মত্যাগকে এ জাতি ‘স্যালুট’ না করলে, আমরা দিনের পর দিন ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতি থেকে একটি ‘কৃতঘ্ন’ জাতিতে পরিণত হবো না কি? আর এটি হলে কি ভবিষ্যত প্রজ্ন্ম আমাদের ক্ষমা করবে? কারণ ‘অকৃতজ্ঞ’ ব্যক্তিকে নাকি আল্লাহ-ও পছন্দ করেন না। আর যাকে আল্লাহ পছন্দ করেনা, তাকে কি বিশ্বের মানুষরা পছন্দ করবে? বাংলাদেশে বাঙালির উচিত বিশ্বে একটি কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে ভারত আর সোভিয়তে ভূমিকাতে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করা, আর এদেশের আগামি প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে ভারত-সৌভিয়েত ভূমিকা জানানোর জন্য পাঠ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু এ প্রত্যাশা কি পুরণ হবে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের?
:
[১০ পর্বে লেখাটি শেষ হলো। লেখাটির তথ্য সংগ্রহে পত্রপত্রিকা, আমার পুরণো প্রবন্ধ ও নেট থেকে সহযোগিতা নেয়া হয়েছে]


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন