মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ৫ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২০ ]


বাংলাদেশকে সহায়তার পেছনে ভারতের গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আবেগ বা উৎসাহের ভূমিকা যতটা না ছিল, তার চেয়ে মুখ্য ছিল ভৌগোলিক নৈকট্য এবং কৌটিল্যের ভাষায় এই যে, ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’। এপ্রিল নাগাদ প্রায় তিন লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনি। প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ শরণার্থী হতে শুরু করে। ফলে গুণগতভাবে একদম ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এ সংকট তখন বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজে ভারত কালবিলম্ব করেনি।
:
ভারতের প্রথম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ২৬ মার্চ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং তাঁর সরকারের উদ্বেগের কথা জানান। পরদিন ভারতিয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক হয়। রাজ্যসভায় এক বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বলেন। নইলে পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড ভারতের জন্য যে সুযোগ তৈরি করেছে, তা হয়তো নষ্ট হবে। এই সতর্কতামূলক মনোভাব নিয়ে ভারত নিজের গণমাধ্যম, প্রতিনিধি ও অন্যান্য উপায় কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের ওপর এর প্রভাব, বিশেষত উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গ তুলে ধরতে থাকে। কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও তারা দেরি করেনি। এসবের পেছনে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার উদ্দেশ্য যেমন ছিল, তেমনই ছিল বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশের ভেতর জাতীয় মতৈক্য গড়ে তোলা এবং তার পাশাপাশি বাংলাদেশিদেরও কাছে টেনে নেওয়া।
:
২৭ মার্চ দুপুরে কলকাতা রেডিও তাদের নিয়মমাফিক অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রেখে বাংলা দেশাত্মবোধক গান আর বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের সংবাদ বারবার পরিবেশন করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি, ঢাকার শিক্ষার্থীরা মধ্য-মার্চেই যেটিকে জাতীয় সংগীত ঘোষণা করেছিল, ঘন ঘন বাজানো হয়। স্বাধীনতা বিষয়ে তখনো ভারতের অবস্থান নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও, গানটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে হূদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামরিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষ শিগগির আশ্রয়, সাহায্য ও পরামর্শের জন্য ভারতের শরণাপন্ন হতে শুরু করে।
:
ভারত দক্ষ হাতে শরণার্থী সমস্যারও একটা ব্যবস্থাপনা করেছিল। বাংলাদেশের কেউ ভারতে পৌঁছালে খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তা মিলত। জুন মাস নাগাদ প্রতিদিন এক লাখ করে মানুষ ভারতে শরণার্থী হতে থাকে। ভারতের অর্থনীতিতে এর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। অর্থনীতির দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতের আচরণ ছিল হূদ্যতাপূর্ণ। অন্যদিকে, শরণার্থীরা নির্বাসিত সরকারের গেরিলা সংগ্রহেরও বাস্তব সমাধান করে দিয়েছিল। প্রচুর পরিমাণে মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যেত শরণার্থীদের থেকে। ভারতের কোনো নিরাপদ স্থানে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পরে পাকিস্তানি বাহিনির বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেশে পাঠানো হতো।
:
বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকার এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিবাহিনি ইত্যাদি গড়ে তুলতে ভারত ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে বৈদ্যনাথতলায়। পাকিস্তানি বাহিনির চাপে শিগগির প্রবাসী সরকার ভারতে সরে যেতে বাধ্য হয়। তখন কলকাতায় স্থাপন করা হয় এর প্রধান কেন্দ্র। অস্থায়ী সরকারের ব্যয়ের বড় অংশই বহন করে ভারত। এর ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে অনেক অবাধে ও ব্যাপক মাত্রায় প্রচারণা চালানো সহজ হয়।
:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়ও ভারত সহায়তা করে। কলকাতা রেডিও স্টেশনের একটি তলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জায়গা করে দেওয়া হয়। এর কার্যক্রম শুরু হয় জুন মাসে, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। ভারতের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে এ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা সম্ভব হয়।




লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন