মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ৮ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২৩ ]


মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্ব

:
আমাদের স্বাধিনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা, ত্যাগ সম্পর্কে আলোচনা হয় কমবেশি। অবশ্য ভারতের অবদান ও ত্যাগের কথা অনেকে বলতে কিছুটা কৃপণতা করে থাকে, যদি তাতে আমাদের কৃতিত্ব কমে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদানের কথা তো আমরা এখন আর মনেই করি না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য সেসব স্মরণ করা খুব প্রয়োজন মনে করি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালকে দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অধ্যায় হলো, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগের সময় এবং দ্বিতীয় অধ্যায় হলো, মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরের সময়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন খুবই তরুণ এবং সেনানায়করাও ছিলেন বেশ অল্পবয়সী। তাই তাঁরা আবেগপ্রবণ ছিলেন বেশি, কিন্তু তাঁদের বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা ছিল কম।
:
সোভিয়েতের সঙ্গে মৈত্রি চুক্তির আগে ভারত সরকারের অবশ্যই দ্বিধা ছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না? ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার বলয়ের বাইরের বিশ্বের প্রায় সব দেশই ছিল পাকিস্তান সরকারের সমর্থক। বিশেষ করে মহাশক্তিধর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এসব কথা বিবেচনায় রেখে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছিল। কিন্তু বহির্বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধও জিইয়ে রাখতে চাচ্ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক বা পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ বেধে যাক, এমনটা ভারত সরকার চাচ্ছিল না। ১৯৬১ সালে চীন যখন ভারত আক্রমণ করে, তখন ভারতিয় বাহিনি চীনাদের কাছে প্রচণ্ডভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল। তাই চীনভীতি ভারত সরকারের মাঝে কার্যকর ছিল এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ভয় ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে চীন হয়তো পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসবে।
:
মৈত্রি চুক্তির একটি ধারায় ছিল, দুটি দেশের কোনো একটি অন্য রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এ ধারা সংযোজনের ফলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রায় সবাই বিশ্বাস করল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এবার আর বাধা রইল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৮ আগস্ট নয়াদিলি্ল এলেন এবং ১২ তারিখে প্রস্থান করেন। ৯ আগস্ট মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত সরকার এমন একটি মৈত্রি চুক্তি করার জন্য একাত্তরের ২৬ মার্চের পর থেকেই চেষ্টা করে আসছিল। সোভিয়েতের পক্ষ থেকেই ব্যাপারটা বিলম্বিত হচ্ছিল। কিন্তু মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া ত্বরান্বিত হয়েছিল হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরকে কেন্দ্র করে। একাত্তরের ৮ জুলাই হেনরি কিসিঞ্জার রাওয়ালপিন্ডি এসে পেঁৗছলেন। ৯ জুলাই খুব সকালে সর্বোচ্চ সতর্ক গোপনীয়তায় তিনি চীনে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচার করা হয়েছিল, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য তাঁকে নাথিয়াগলিতে নেওয়া হয়েছে। ১১ জুলাই তিনি ইসলামাবাদে ফিরে আসেন। ওই সংবাদ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় পক্ষকে দারুণভাবে বিচলিত করে। ফলে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৮ আগস্ট দিলি্লতে পেঁৗছান। ৯ আগস্ট মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবার ভারতের চীনভীতি দূরীভূত হলো। 
:
মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত পূর্ণোদ্যমে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা অনেক বৃদ্ধি পেল। ভারতিয় নিয়মিত বাহিনি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করল মুক্তিযোদ্ধাদের। ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়, তার সূচনাকারী কে তা অনেকের কাছে অস্পষ্ট। ওই চূড়ান্ত যুদ্ধ তো শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩ নভেম্বর। সেই তারিখ পিছিয়ে গিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধীর ইউরোপ ও আমেরিকা সফরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায়। তা ছাড়া খুব অল্প সময়ে যুদ্ধ জয়ে সহায়ক হবে এমন অধিকতর প্রস্তুতি সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। 



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন