মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ ভারত ছিটমহল, সিমান্ত সমস্যা ও আমাদের ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৪০ ]


বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক নানা ঋণাত্মক প্রপঞ্চে এসেও মূলত ধনাত্মক। কারণ বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র দেশটির চারপাশ ঘিরেই বলতে গেলে ভারত। আবার বাংলাদেশের ৩-দিক ঘিরে বসবাসকারী ভারতীয়রাও হচ্ছেন মূলত ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাভাষিক’। যাদের অনেক আত্মীয় স্বজনের বসবাস এই বাংলাদেশে। ভারতে অবস্থানকারী অনেক প্রতিষ্ঠিত বাঙালির নিজের কিংবা পিতার কিংবা পিতামহের বসবাস ছিল এককালে বাংলাদেশে। যে কারণে কোলকাতার অনেক বাঙালি বাংলাদেশ শুনতেই নস্টালজিয়ায় ভোগে, কেউ কেউ দেখতে আসে তার পূর্ব পুরুষের পিতৃভূমি বাংলাদেশকে। কোলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালের মালিকের পৈত্রিক নিবাস নারায়নগঞ্জে ছিল বিধায়, বাংলাদেশীদের জন্যে পিয়াসলেসে ভারতীয়দের মতই সম অধিকারের ব্যবস্থা রেখেছেন তিনি। একাত্তরে বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের আত্মত্যাগ, ১-কোটি স্মরণার্থীকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা, আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারত বিশেষ করে প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ বিষয়ে অত্যন্ত জোরালে ভূমিকা, বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে সরাসরি ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ৭ম-নৌবহরের আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজের বঙ্গোপসাগরে প্রস্ত্ততি, স্বাধীনতার পর পরই বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে তড়িৎ প্রত্যাহার ইত্যাদি সবই এখন ইতিহাসের অংশ।
এরপর গঙ্গা তথা পদ্মা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। নব্য শাসকরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নিয়ে গেছেন ভারত থেকে চীন আর পাকিস্তানের দিকে, যারা আবার ভারতের চিরশত্রু পর্যায়ের প্রতিবেশী। পরবর্তীতে নানাভাবে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কে সৃষ্টি করা হয়েছে নানাবিধ টানাপোড়েন, ফাটল এবং সন্দেহ সংশয়। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দেয়া হয়েছিল আশ্রয় আর সহায়তা। বাংলাদেশের মাটিতেই বাংলাদেশের সরকারের সহযোগিতায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরবরাহের জন্যে ১০-ট্রাক মারাত্মক অস্ত্র আমদানী করা হয়েছিল, যা ঘটনাক্রমে ধরা পড়ে যায় কিন্তু কত ট্রাক যে ভারতের ভেতর চলে গিয়েছিল, তার হিসেব হয়তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ না জানলেও, ভারতের কাছে তার হিসেবে পৌঁছে গেছে ঠিকই।

এ টানাপোড়েন সত্বেও পূর্বে বর্ণিত ভারতীয় ইতিবাচক ঐতিহাসিক কর্মকান্ডে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশীদের একটি বিরাট অংশ মূলত ভারতপন্থী এবং তারা সব সময়ই বাংলাদেশ ভারত সুসম্পর্ক প্রত্যাশী, যেন উন্নয়নশীল এ প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটো সামরিক প্রতিযোগিতার চেয়ে একে অন্যের সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আগে পাশাপাশি। যদিও নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক বহুবিধ কারণে এদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ আবার মারাত্মক ‘ভারত বিদ্বেষী’। এদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও বলা হয়ে থাকে যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতপন্থী এবং বিএনপি হচ্ছে পাকিস্তানপন্থী। ২-দলের নানাবিধ কার্যক্রমেও কথাটির সত্যতা মেলে প্রায়ই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সব সময়ই প্রত্যাশা করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রক্ষার। ৮-বছরের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সহযোগিতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও চুক্তি করে তার প্রমাণ রেখেছেন, যা ভারতের ছিল দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ছিটমহল বিনিময়। আমরা এদেশের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশী হিসেবে যাকে সাধুবাদ জানিয়েছি এবং প্রত্যাশা করেছি যে, হয়তো এখন আর বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ-বিজিবি’র মধ্যে গোলাগোলি হবে না। ধান কাটা বা মাছ ধরা নিয়ে লড়াই হবে না দুদেশের মানুষ আর বর্ডার গার্ডদের মধ্যে।

কিন্তু আমাদের এ ইতিবাচক প্রত্যাশাকে ধারাবাহিকভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে ভারতীয় কিছু ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’। প্রায় প্রত্যহ আমরা পত্র-পত্রিকায় আমাদের নীরিহ মানুষ হত্যার খবর জানতে পারছি বর্ডারে। সাম্প্রতিক একটি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, কেবল ২০১০ সনে বিএসএফ এর গুলিতে ৯৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে, মানে গড়ে প্রতি ৪-দিনে একজন বাংলাদেশী হত্যা! বিষয়টি অত্যন্ত কষ্টকর এবং আবেগঘন! মানুষের জীবন কি এতোই তুচ্ছ? সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা হচ্ছে, এদেশের ১৪-বছর বয়সী ‘ফেলানী’ নামক এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা এবং তার লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা। যে হৃদয় বিদারক করুণ দৃশ্য এদেশের সকল মানুষকে কমবেশী কষ্ট দিয়েছে। মানুষ হয়েছে বিষয়টির বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু কেন এই নির্মম হত্যাকান্ড?

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যখন একই মুদ্রা, পাসপোর্ট, ভিসাফ্রি বর্ডার করে তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একে অন্যের দেশে স্বাগত জানাচ্ছে, সেই একুশ শতকে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের এই মধ্যযুগীয় আচরণ কেন? ভারতকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ পাকিস্তান নয় এবং বাঙালিরাও নয় পাকিস্তানী। বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সহযোগিতা, তেমনি ভারতেরও প্রয়োজন বাংলাদেশের আন্তরিক সহযোগিতা। কিন্তু এভাবে যদি আমাদের ফেলানীরা মরতেই থাকে এবং প্রতি ৪দিনে যদি একজন বাংলাদেশী ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে মারা গিয়ে কাঁটাতারে ঝুলতে থাকে, তবে বাংলাদেশী মানুষ কি তা মানবে? কারণ এই ফেলানীরাতো আমাদেরই স্বজন! সবশেষ খবর, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী হত্যার ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ রুপি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশন সোমবার এ ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ফেলানীর পরিবারকে এ অর্থ প্রদানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একদিকে ফেলানী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বিচারে নির্দোষ ঘোষণা করা অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়?

ভারতের উচিত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ইতিবাচক মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশী মানুষদেরকে তাদের পক্ষে নেয়া। এটি করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে ভারতকে তার ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে ছোট ছোট বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে আন্তরিকতা ও যৌক্তিকতার সঙ্গে। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের সিটমহল ১১১টি এবং জমির পরিমাণ ১৭,০৫৮ একর, অপরদিকে ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের সিটমহল ৩২টি ও জমির পরিমাণ ৭,১১০ একর। অর্থাৎ সংখ্যা ও পরিমাণের দিকে ভারত এগিয়ে। ছিটমহল সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হয়েছে দুদেশের শান্তির স্বার্থেই।  প্রশংসিত হয়েছে উভয় দেশের মানুষের কাছেই।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নৌ, রেল ও সড়ক পথে ভারত তার বিচ্ছিন্ন ৭টি প্রদেশে যাতায়াতের সুবিধা পেলে ভারতের সুবিধা হবে অনেক। কিন্তু বাংলাদেশকে সেজন্যে যেতে দিতে হবে নেপাল ও ভুটানে সড়ক পথে যথাযথ যৌক্তিক ট্যাক্সের বিনিময়ে। আর আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে বাংলাদেশের নৌপথ, রেলপথ ও সড়কপথ ব্যবহারের জন্যে ভারতকেও দিতে হবে যথাযথ ট্যাক্স। সিঙ্গাপুর থেকে মালয়শিয়ার ভেতর দিয়ে থাইল্যান্ড গিয়েছে যে মহাসড়কটি, তা ব্যবহারের জন্যে অন্যদেশী এবং খোদ মালয়েশিয়ান যে কোন গাড়িকেও পরিশোধ করতে হয় ‘টোল’ নামক উচ্চহারে ট্যাক্স। কেবল আন্তর্জাতিক রেটে যথাযথ ট্যাক্স পেলেই ভারতীয় যান চলাচলের জন্যে সুপরিসর আন্তর্জাতিক মানের আলাদা রাস্তা তৈরী হতে পারে ভারতীয় বাস-ট্রাকের জন্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে, এই রাস্তা তৈরীর অর্থ যোগানের বিষয়টিও ভাবতে হবে ভারতকে। ভারত তার চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারে বাংলাদেশের কাছে। বাংলাদেশ অন্তত যতদিন বিদ্যুতে স্বনির্ভর না হয়, ভারত-ভুটান থেকে কিনতে পারে বিদ্যুৎ।

কিন্তু এ সব কিছুর জন্যে বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের আনতে হবে আস্থায়। ভারতের প্রতি বাংলাদেশী কোটি মানুষের যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তা দূর করতে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। এ জন্যে প্রাথমিক কাজটি হচ্ছে সীমান্তে বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা বন্ধ করা। কারণ কথায় কথায় মানুষ হত্যা আজকের কালচার হতে পারে না, অন্তত বাংলাদেশের নীরিহ শান্তি প্রিয় জন্যে। এ বিষয়ে এদেশের একজন সাধারণ নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন