শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ-ভারতের শীত মৌসুমে পানি সমস্যার বিশ্লেষণ # ৪৭



বাংলাদেশ-ভারতর শীত মৌসুমে পানি সমস্যা :
এদেশের নদীগুলো শুকানোর জন্যে কি সত্যিই ‘ফারাক্কা’ দায়ী?
ভারতকে কেন খামোখা অযৌক্তিক দোষারোপ করা হয়?

নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মত বিস্তৃত নদীগুলোর দু’তীরের মানুষের জীবন আসলে নদীকেন্দ্রীক। প্রধানত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান এই নদীগুলোর অধিকাংশই এদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। বলা হয়ে থাকে কমপক্ষে ৫৪-টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও শাখানদী-উপনদী নিয়ে তার সংখ্যা আসলে কয়েক’শর মত। নদী নির্ভরশীল বাংলাদেশের এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, শুকনো মৌসুমে ‘পানির স্বল্পতা’ এবং বর্ষা মৌসুমে ‘জলাধিক্য’ ও ‘নদীভাঙন’। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সরকারী-বেসরকারী নানা পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারের কারণে বিশ্বাস জন্মে যে যে, ‘‘শুকেনো মৌসুমে (শীতে) ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে এদেশের নদীগুলো শুকিয়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে, বিপরীত দিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত ‘তার পানি’ বাংলাদেশের দিকে ‘ঠেলে’ দিয়ে ভাটির এ দেশটিকে ডুবিয়ে মারছে’’। এ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বেশেষে কোটি কোটি মানুষ উপরে বর্ণিত কথাগুলো বিশ্বাস করার কারণে, তাদের বর্তমানে দুর্ভোগের জন্যে ‘ভারত’কে দায়ী করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। নদীসৃষ্ট আমাদের বর্ণিত দুর্ভোগ্যের জন্যে প্রকৃতপক্ষে ‘ফারাক্কা’ তথা ‘ভারত’ সত্যি কি দায়ী? না কেবলমাত্র প্রতিবেশী একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা টিকিয়ে রাখার এটি একটি ষড়যন্ত্র? বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে।

এদেশে প্রবাহমান নদীগুলোর প্রায় সবগুলোর উৎস ‘উজান’ তথা ভারতে এবং মোহনা তথা ‘মিলনস্থল’ বাংলাদেশে। যেমন গঙ্গার উৎস ‘গঙ্গোত্রী হিমবাহ’ এবং ব্রহ্মপুত্রের উৎস ‘মানস সরোবরে’। নদীর ধর্মানুযায়ী নদী তার প্রবাহিত গতিপথে সকল প্রকার বাঁধা ও অসমতা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে প্রবাহিত হয়। সৃষ্ট সর্পিল বাঁকের কারণে ক্ষয়ক্রিয়া তথা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। প্রথাগতভাবে নদীগুলোর জীবনকাল ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। উৎসে নদীগুলো ‘যৌবন’দীপ্ত তথা খরস্রোতা থাকলেও, বাংলাদেশে নদীগুলো মূলত তারুণ্য-যৌবন হারিয়ে ‘পরিণত’ বয়সে মন্থর ও বিসর্পিল বা বিনুনি আকতি নিয়ে এদেশে প্রবেশ করে এবং অনেক নদী কেবল ‘বার্ধক্যে’ এদেশে প্রবেশ করে বিধায় নাব্যতা হারায়। পলি ও মিহি বালুতে গঠিত নদীতীর, সাম্প্রতিক মজুতকৃত তীরের নরম পদার্থসমূহ ভাঙনের পক্ষে খুবই সংবেদনশীল। তা ছাড়া এ অঞ্চল গঠনগত প্রকৃতি তথা নদীগুলো দক্ষিণমুখী, সর্পিল, চরোৎপাদী বা বিনুনি, সরলাকার, সূক্ষ্ম বালুকণাময় তলদেশ, নরম পলল গঠিত ভূমি, পরিমিত ঢাল, ভাঙনপ্রবণ তীর ও পরিবর্তনশীল নদীখাতজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে, উজান থেকে নদী ভাঙনজাত প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন মাটি-পলি বা উপজাত পদার্থ ‘ভাটি’তে নিয়ে এসে নতুন চরের সৃষ্টি করে, যে কারণে নদীগুলো চর সৃষ্ট কারণে ভরাট হয় এবং বর্ষায় পানি প্রবাহ উপচে অকাল বন্যার সৃষ্টি করে। এগুলো মূলত হয় নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে বদ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর ও পলিজাত উপভূমি সৃষ্টি হয়ে। এই নদীগুলো কেবল ভারত থেকে ২.৪ বিলিয়ন টন নরম মাটি-পলিই নিয়ে আসেনা, বর্ষামৌসুমে প্রবল জলস্রোতে অনেক ‘নুড়িপাথর’ বহন করে, যা বাংলাদেশে সিলেটসহ বেশ ক’টি জেলায় সংগৃহীত হয় এবং এদেশের নির্মাণ শিল্পে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে ভারতের নদী প্রবাহ আমাদের উপকারও করে বটে।

প্রাকৃতিক কারণে ১৭৮৭ সনে ‘তিস্তা’র মধ্যে বিনুনি প্রকৃতি, প্রচরণ ও বিপুল বালুস্রোত প্রবাহের কারণে ‘আত্রা’ই নদীমুখে জমা হয়ে, তিসত্মার প্রবাহ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে ‘ঘাঘট’ নদীর দিকে নবরূপে প্রবাহিত হয়। অবার ধরলা বর্ষাকালে প্রায় ‘যৌবনপ্রাপ্ত’ নদীশ্রেণিভুক্ত হলেও, শুকনো মৌসুমে এটি মৃতপ্রায় বিনুনি প্রকৃতিতে পরিণত হয়। ১৭৮৭ সালে অসামের প্রবল বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের নদী প্রবাহ তথা ধারা পরিবর্তিত হয়ে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’ মৃতপ্রায় নদীতে রূপান্তর হয়। এভাবে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মেই এ অঞ্চলের নদীগুলো তাদের পথ পরিক্রমা খুঁজে নেয়।

এ অঞ্চলের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গ্রীষ্মকালে প্রবল বৃষ্টিপাত ও শুকনো মৌসুমে বিরল বৃষ্টি। গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু একই সময়ে হওয়াতে হিমালয়ের বরফগলা পানি ও প্রবল বৃষ্টিপাত মিলে ভাটি অঞ্চলে প্রবল বেগে নেমে এসে বন্যার সৃষ্টি করে। বিপরীত দিকে শুষ্ক মৌসুমে শীতকাল থাকাতে হিমালয় অঞ্চলে বরফ জমাট বাঁধে এবং বৃষ্টি বিরল হওয়াতে জলপ্রবাহ হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে উজানের নদী সম্পৃক্ত মানুষগুলো তাদের জল চাহিদা পুরণের জন্যে ভাটিতে অবাধ জলপ্রবাহে কৃত্রিম বাঁধা সৃষ্টি করে। এরূপই একটি বাঁধা হচ্ছে ‘ফারাক্কা বাঁধ’, যা বাংলাদেশ সীমামেত্মর ১৮ কিমি উজানে ভারত নির্মাণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ও সরকারী তথ্য বিশেøষণে দেখা যায়, ফারাক্কা বঁাধের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও কিংবা বাঁধ নির্মাণের অনেক আগেই গত ১০০-বছরে রাজশাহীর ১০টি নদীর মধ্যে ৯টিই এখন মৃত নদী। যশোরের ৮টি নদী, কুড়িগ্রামের ১২টি নদী মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ৬টি নদী সংস্কারের অভাবে ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। গাইবান্ধার তিনটি প্রধান নদীতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হচ্ছে। পঞ্চগড়ে প্রবাহিত ২০টি নদীর মধ্যে ১০টি নদী, রংপুর জেলার ১০টি নদীই ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। দিনাজপুর জেলার মৃত নদীর তালিকায় রয়েছে তিনটি নদী। কুমিল্লার তিনটি নদীর অস্তিত আর খঁুজে পাওয়া যাবে না। বৃহত্তর বরিশাল জেলা থেকে হারিয়ে গেছে ৬টি নদী। টাঙ্গাইল থেকে তিনটি, ফরিদপুর থেকে তিনটি, নড়াইল থেকে ৪টি নদী, কুড়িগ্রাম থেকে ১০টি, গাইবান্ধা থেকে তিনটি, মানিকগঞ্জ থেকে ২টি, খুলনার তিনটি, ঝিনাইদহের ২টি, বগুড়ার ৫টি, পাবনার ২টি, নেত্রকোনার ১২টি, চঁাপাইনবাবগঞ্জের ২টি এবং সুনামগঞ্জের ১০টি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক কারণে। এছাড়া মাদারীপুর, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, শরিয়তপুর থেকেও একাধিক নদী বিলুপ্ত হয়েছে একই কারণে। এমনকি বৃহত্তর ঢাকা জেলার ওপর দিয়ে এক সময় ৩১টি নদ-নদী প্রবাহিত হতো। এর মধ্যে ১২টি নদী মজে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বর্ণিত কারণে।

বিগত ১০০ বছরে আমাদের প্রায় ২৪,১৪০ কিমি নদীপথের আঁকাবাঁকা সর্পিল চমৎকার নামধারী ৭০০ জালিকার মত নদীপ্রবাহের অনেক নদী এখন মৃত কিংবা মৃতপ্রায়। অসিত্মত্বলোপ বা বিলুপ্তপ্রায় এ নদীগুলো হচ্ছেঃ ডাহুক, তলমা, নাগর, কোকিল, টাংগস, ঘাঘট, ঢেপা, আত্রাই, বুড়িতিসত্মা, যমুনেশ্বরী, ত্রিমোহনী, ধরলা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, জিজিরাম, করতোয়া, ছোট যমুনা, শিব, মহানন্দা, পাগলা, বারানাই, ভোগাই, নিতাই, কংস, সোমেশ্বরী, ধনু, পিয়াইন, বানার, কুমার, মধুমতি, নবগঙ্গা, ফটকি, চিত্রা, ভৈরব, কপোতাক্ষ, গোমতী, স্বাতি, খারভাজা, আখির, খারখরিয়া, গদাধর, সনকোশ, নোয়াডিহিং, কাপিলি, টাঙ্গন, কোরাম, বড়াল, জলঢাকা, কল্যাণী, হুরাসাগর, তালান, লক্ষ্যা, ভুৃবনেশ্বরী, ইলশামারী, আইমন, সুতিয়া, বোথাই, নিতারী, পানকুরা, ধানু, মানস, কালনি, হরি, রক্তি, তিতাস, খেরু, কাকড়ি, জাঙ্গালিয়া, বুড়িগাঙ, বিজলী, ইছামতি, জলাঙ্গি, চন্দনা, পানগুবি, কবা, পাংগানি, গড়াই, পাংল, আত্রাই, গলাঙ্গী, শীলা, কাগীবাগ, চন্দনা, পটুয়া, ধানসিঁড়ি, নলবিটি, কালিদা, বুড়া গৌরাঙ্গ, হংসরাগ, ডাংমারি, লতাবেড়ি, সাতনলা ইত্যাদি। উপর্যুক্ত নদীগুলোর বিলুপ্তি কিংবা গথিপথ বার্ধক্যে পরিণত হওয়াকে কি ‘ভারতের কারসাজি’ বলবো? এভাবে আমরা গত ১০০ বছরে হারিয়ে ফেলেছি ১০০-এর বেশি নদী। হারিয়ে যাওয়া এই নদীগুলোর জন্যে কিন্তু ফারাক্কাকে দায়ী করার কোন উপায় নেই। এর অধিকাংশ নদীর সঙ্গে ফারাক্কার কোন যোগসূত্র ছিলনা কিংবা এখনো নেই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের নদীর গঠনগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নাব্যতা হারায়, ভাঙন ও চর সৃষ্টি হয় এবং বর্ষায় প্রবল জলপ্রবাহের কারণে বন্যা এবং শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে কম জল প্রবাহের কারণে সকল নদীতে (কেবল গঙ্গায় নয়) নাব্যতা সংকটের সৃষ্টি হয়। হ্যা, যদিও শুকনো সিজনে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে গঙ্গা তথা পদ্মায় কম জল আসে এবং এ প্রেক্ষিতে নাব্যতা, লবণাক্ততা, নৌপরিবহণ, কৃষি ও মংস্য প্রজননে সমস্যা দেখা দেয় কিন্তু বাংলাদেশের পদ্মাসহ অন্যান্য উল্লিখিত নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের জন্যে এটিই কিন্তু একমাত্র কারণ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ভূপ্রাকৃতিক কারণ।

তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, গঙ্গার পানি আমাদের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ‘গঙ্গার তীরবর্তী’ ভারতের নাগরিকদেরও। যারা সড়কপথে ভুটান বা নেপাল ভ্রমণ করেছেন, তারা দেখেছেন ‘জলপাইগুড়ি’ বা ‘কুচবিহার’ জেলার, এমনকি ‘ভুটানের ফুল্টসলিং’ এলাকার শুকনো নদীগুলো কিভাবে ২-৩ ইঞ্চি পানি নিয়ে চিক চিক করছে, সেতুগুলো ঠায় চরের উপর দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ পায়ে হেটে নদী পার হচ্ছে। ঐ অঞ্চলের নৌকা, মাছশূন্য নদীগুলোর তুলনায় ‘ভাটির দেশ’ হিসেবে আমরা কিছুটা ভাল অবস্থানে নই কি?
আন্তর্জাতিক এমন কোন নদীবণ্টন আইন বা প্রটোকল নেই যাতে ভারত ও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং কোন আইনেই ভারত থেকে জোর করে পানি আনা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে, বাস্তবতায় ফিরে এসে অযথা নদী সংকটের জন্যে ভারতকে একতরফা দায়ী না করে, সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে যৌথভাবে ড্রেজিং, জলাধার নির্মাণ, ভাঙন প্রতিরোধ, গথিপথ সহজীকরণ ইত্যাদির মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও উভয় দেশের নদীনির্ভর মানুষকে বঁাচানোর জন্য যৌথভাবে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় মানুষই বাঁচতে পারে।

[ সঙ্গে প্রদত্ত গঙ্গার মানচিত্রে বোঝা যাবে, গঙ্গার প্রবাহের প্রতি বাংলাদেশে চেয়ে কত বেশি ভারতীয় মানুষ নির্ভরশীল, এবং তার গতিপথ ভারতে কত বিস্তৃত! ]


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ : ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রসঙ্গ ! # ৪৬


হাজার বছরের চির পরাধীন এবং অবশেষে একাত্তরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মহান বিষয়ের ৪৩-তম দিন পালনে আমরা এখন সবাই উদগ্রূীব। স্বাধীনতা অর্জনে ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ খেতাব ও কমবেশী সুযোগ সুবিধাও আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি স্বল্প সম্পদের এদেশে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা এখন বংশানুক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নাতিপুতিদের দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। ৭-জন বীর শ্রেষ্ঠর সম্মানে এদেশের মানুষ এখনো আপ্লুত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করেছি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশীদেরও সরকার সম্মানিত করছেন এবং সে লক্ষে একটি তালিকাও নাকি তৈরী হয়েছে। যা সবই প্রশংসার দাবী রাখে।

কিন্তু একটি ব্যাপার এদেশের অসাম্প্রদায়িক ‘কৃতজ্ঞ’ বাঙালিকে ‘দহন’ করছে প্রতিনিয়ত সেই একাত্তর থেকেই। আর তা হচ্ছে, একাত্তরে আমাদের চরম বিপদের সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল, তার স্মরণে কিংবা তারা কিভাবে কতটুকু আমাদের সহায়তা করেছিল তা সুষ্পষ্টভাবে সকল জাতির মাঝে কখনো ব্যাপক প্রচার না হওয়া। দীর্ঘদিন এদেশের মানুষ নানা প্রচার মাধ্যমে শুনে এসেছে, যুদ্ধের পর ভারত নাকি এদেশের অনেক সম্পদ ‘পাচার’ করে তাদের দেশে নিয়ে গেছে। এর সত্যা-সত্যও প্রকাশিত হওয়া দরকার ৪৩-তম বিজয়ের প্রাক্কালে এ জাতির সামনেই।

আমারা কমবেশী জানি, পাকিস্তানীদের ভয়ে প্রায় কোটি শরণার্থী বাংলাদেশের ৩-দিকের বর্ডার দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের দেয়া হয়েছিল আশ্রয়, খাদ্য, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। কত মানুষের জন্যে ভারতের কত আশ্রয় কেন্দ্র ছিল সেখানে তার হিসেব কি আমরা কখনো করেছি? সরবরাহকৃত খাদ্য, ক্যাম্প আর অস্ত্রের পরিমান কি ছিল? এ ক্ষেত্রে ভারতের জনগণ কি ত্যাগ স্বীকার করেছিল এ জাতির স্বাধীনতায় বা ট্যাক্স দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্যে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিও কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে দান করেছিল বিনে পয়সায়? তার মূল্য ছিল কত? এ ছাড়া যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ডাকটিকেট, পোস্টার, মুদ্রা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল ভারত থেকেই। সরকারী দফতরও ছিল সেখানে। সেগুলো কিভাবে হয়েছিল?

একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে সরাসরি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সেক্টরে যুদ্ধে নামে। পাকিস্তানের মত একটি ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন ও চীনের সহায়তাপুষ্ট শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ভারতের কি কোন ক্ষতি হয় নি? আমাদের জানা ও বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে এ যুদ্ধে (বাংলাদেশ যুদ্ধে) ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট কত সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছিল? যার আর্থিক মূল্য কত? মানুষ ছাড়াও এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত অস্ত্র, বিমান, নৌ-জাহাজ ইত্যাদির পরিমান ও তার আর্থিক মূল্যমান কি আমরা বলতে পারবো? যুদ্ধে ভারতের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমান কি খুব নগণ্য ছিল?

ভারত ছাড়াও এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রকারে আমাদের সহায়তা দিয়েছিল? মানে অস্ত্র, অর্থ, কূটনৈতিক কিংবা অন্য আর কি কি ভাবে? যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানীদের রক্ষায় যখন বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ‘সপ্তম নৌবহর’ এলো বাংলাদেশের উপর আক্রমন চালাতে, তখন তা প্রতিরোধে সৌভিয়েত ৪০-জাহাজের পারমাণবিক নৌ-বহর ও ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ‘ভিক্রান্ত’ কিভাবে তার মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিল, তার ইতিহাস কি এদেশের শিশুরা জানবে না? স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী গঠনে ভারত কি কি বিমান ও নৌযান বাংলাদেশকে দান করেছিল, তাও প্রকাশিত হওয়া দরকার সত্য ইতিহাস সামনে আনার প্রয়াসে।

আরো জানা দরকার, আত্মসমর্পনের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করার লক্ষে, পাকিস্তান নৌবাহিনী কর্তৃক পুরো বঙ্গোপসাগরে ‘অসংখ্য ভাসমান মাইন’ ছড়িয়ে দেয়ার গল্প এবং স্বাধীনতার পর তা উদ্ধারে এসে মাইন বিস্ফোরণে সৌভিয়েত নাবিকদের পতেঙ্গা সৈকতে নির্মম নিহত হওয়ার কাহিনি। নিহত এ সোভিয়েত সৈনিকরা হয়তো জন্ম নিয়েছিল লেনিনগ্রাদ বা ভারখয়োনস্কের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে, যারা অন্য এক অচেনা জাতির ‘মুক্তি সংগ্রামে’ এসে নিজের জীবনটি দান করলেন পতেঙ্গা সৈকতে! এদের সাহসের গল্প আমাদের না শোনালে, এ বীরত্বের কাহিনি আমাদের না জানালে, এদের স্মৃতিতে স্মৃতিশৌধ আমরা না বানালে, এদের আত্মত্যাগকে এ জাতি ‘স্যালুট’ না করলে, আমরা দিনের পর দিন ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতি থেকে একটি ‘কৃতঘ্ন’ জাতিতে পরিণত হবো না কি? আর এটি হলে কি ভবিষ্যত প্রজ্ন্ম আমাদের ক্ষমা করবে? কারণ ‘অকৃতজ্ঞ’ ব্যক্তিকে নাকি আল্লাহ-ও পছন্দ করেন না। আর যাকে আল্লাহ পছন্দ করেনা, তাকে কি বিশ্বের মানুষরা পছন্দ করবে?

অদ্যাবধি আমরা একাত্তরে ভূমি কাঁপানো বাঙলাদেশবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর স্মরণে কোন স্টাচু বানাতে পারিনি ঢাকাতে। ইন্দিরা রোড নামে ফার্মগেটে যে রাস্তাটি আছে, তা কতটুকু ভেবেছেন কি? অথচ যশোরের সংগ্রামী 'বাঘা যতীন' কোলকাতার যেখানে আত্মগোপন করে নিহত হয়েছিলেন, কোলকাতার সে স্থানটির নাম বাঘা যতীন, এমনকি রেল স্টেশনটির নামও।

একজন কৃতজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধান সন্তান হিসেবে বাঙলাদেশে দেখতে চাইছি, একাত্তরে নিহত ভারতীয় আর সোভিয়েত সৈনিকদের স্মরণে অন্তত একটি চমৎকার স্মৃতি শৌধ! যদিও্ এটি নির্মিত হলে বর্তমান আওয়ামী সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমবে হয়তো। কিন্তু তার চেয়ে্ও বেশি আশংখা হচ্ছে, রাতের আঁধারে স্মৃতিশৌধটি মৌলবাদী কর্তৃক ভেঙে ফেলার সম্ভাবনা।

ধর্মে স্নাত বাংলাদেশ প্রেমিক কৃতজ্ঞ মুসলমানগণ এ ব্যাপারে কি বলেন?








ভারত বিদ্বেষীরা কেন 'প্রমিত' 'শুদ্ধ' বাঙলা ব্যবহার করবেন না ! : ৪৫



সপ্তপদি প্রপঞ্চে বাঙলাদেশি মানুষের বেশ একটা অংশ মারাত্মাক ভারত বিদ্বেষী। আমি নানা অনুসন্ধান করেও এ বিদ্বেষীতার তেমন কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাইনি, কেবল পাকিস্তানি আর ধর্মান্ধ চেতনা লালনকারী ছাড়া। আধুনিক বৈশ্বিক রাজনৈতিক চিন্তনে অন্য শক্তিধর (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, বৃটেন, রাশিয়া, জাপান, কানাডা ইত্যাদি) রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে ভারতের চরিত্র কিভাবে "খারাপতর" বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি, তা আমার বোধগম্য নয়। বরং ভারত যদি তার নিজ দেশের স্বার্থচিন্তা করে, তাকে কি কোন রাষ্ট্রকে খারাপ বলা যাবে? বরং ঐ রাষ্ট্রই খারাপ, যে তার নিজ স্বার্থ অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। বাংলাদেশ বরং ভারতের চেয়ে অন্য অনেক শক্তিধর দেশ দ্বারা বেশি শোষিত শাসিত এবং নির্দেশিত হচ্ছে। উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, চীন, বৃটেন, জাপান, রাশিয়া ইত্যাদি। ভারতের চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্য ঘাটতে বাংলাদেশের সাথে চীনের। ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিলেও চীন ব্রহ্মপুত্রে বেশ কটা বাঁধ দিয়েছে তা অনেকে জানলেও, এ ব্যাপারে কোন কথা নেই কারো মুখে সব যেন শত্রুতা ভারতের সাথে। পদ্মায় যেটুকু পানি শুষ্ক মৌসুমে পাওয়া যায়, তা কি ব্রহ্মপুত্রে থাকে? শীত মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রে তো চীনাবাদাম চাষ হয় (চীনের বাদাম?)!

যারা বিনা কারণে এমন ভারত বিদ্বেষী তাদেরকে অনুরোধ করবো তারা বর্তমান প্রচলিত "শুদ্ধ" বা "প্রমিত" বাঙলায় যেন কথা না বলেন। কারণ এ ভাষাটি বর্তমান রাজনৈতিক বাংলাদেশের নয়, এটা পুরোই কোলকাতা কেন্দ্রিক তথা ভারতের ভাষা। এ বিষয়ে বিস্তারিত একটা প্রবন্ধে বলেছিলাম আমি প্রায় ৬-মাস আগে। আবার এখানে তা পুন পোস্ট করলাম।

প্রবন্ধটি পড়ার পর ভারত বিদ্বেষী ভাইদের অনুরোধ করবো, তারা যেন তাদের নিজ্স্ব পূর্ব বঙ্গীয় তথা নিজ নিজ মাতৃভাষা তথা নোয়াখালির, বরিশালি, সিলেটি, চাটগাঁইয়া বা যার যার নিজ ভাষা যেন ব্যবহার করেন। বিষয়টির যৌক্তিকতা বোঝার জন্যে নিচের প্রবন্ধটি পড়তে হবে, কারণ তাহলেই জানা যাবে কিভাবে "বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা কোলকাতা থেকে ধার করা"।
---------------------------------------------------------------------------
আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ৪
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা কি কোলকাতা থেকে ধার করা?
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১২-টি পোস্টের সিরিজ)
বাংলাদেশে প্রচলিত প্রমিত বাংলা (যা মূলত কোলকাতার ভাষা) :
"সালাম বাজার থেকে সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় শিয়াল ডেকে উঠলো। আর উপরে রাখা শাড়িটা ইঁদুরে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললো"
----
বরিশালের ভাষায় :
সালাইমমা আডেগোনে হাউচব্যালা আওয়ার টাইমে হিয়াল ডাইক্কা উঠলো। আর উফরে থোয়া হাড়িডা ইন্দুরে কাইট্টা গুডা গুডা কইরা হালাইলো।
সিলেটি ভাষা- সালাম বাজার থাকি হাইঞ্জাবালা আওয়ার সময় হিয়ালে ডাখ দিয়া উঠলো। আর উফরে রাখা শাড়িটা উন্ধুরে খাটিয়া টুকরা টুকরা খরিলিলো।
নোয়াখালি : সালাইম্যা হানঁজা বাজারোত্তুন হিরনের লগেদি হিয়ালে মেতাই উইটছে ...উর্ফে থুইন্না শারীরে উদুঁরে টুউরা টুউরা করিহালাইছে
সিলেটি : সালাম বাজার তনে হাঞ্জাবালা আওয়ার সময় হিয়াল এইজ্ঞে ডাক মারসে। আর উপরে থোওয়া শাড়িখান ইন্দুরে কাটিয়া টুমা টুমা করিলাইছে।
Anol Ani ফেনি : সালাইম্মা হাঞ্জুইন্না বাজারতুন আইবার সময় হিয়াইল্লা ওগগা চিল্লাই উইটছে। আর ওঁচের শাড়িগান ইন্দুরিয়া কাডি টুরা টুরা করি হালাইছে।
Sharon Kafer চট্টগ্রাম : সালাইম্যা হাঁজইন্যা হাডত্তুন আইবার সমত হিয়াইল্যা ডাক ছাইরগে। আর উওরে রাক্কিলাম দে শাড়ি হিয়ান উন্দুরে কাডি টুওরা টুওরা গরি ফেইল্লে ।
অ-কবি নীল খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় : সালাম বাজারেত্তে সইন্ধেকালে ফিরার সুমায় শিয়েল ডাইকে ওটলো। আর উফরে রাহা শাড়িডা ইন্দুরি কাইটে টুকরো টুকরো কইরে ফেলালো।
মানব বন্ধু চাঁদগাইয়ে : সালাম্মা বাজারত্তুন সন্ধ্যেসন আঁইবার সন ইয়াল ডাহি উট্টি। আঁর উর্দি রাহা শাড়িয়ান অঁদুরে হাডি টুওর টুওর গরি ফেলা-ই।
শুভ মিতা : সালামে বাজারতে হাইজাবেলা অাওনের সুম হিয়াল ডাইক্কা উটলো। অার ওফরে রাহা শাড়িডা ইন্দুরে কাইট্টা কুডি কুডি কইরা লাইলো। (রুপগঞ্জ , নারায়নগঞ্জ)

এভাবে হয়তো বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় উপর্যুক্ত “শুদ্ধ” বাংলাটি রূপান্তর করা হলে ৬৪টি ভাষা আমরা পাবো। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় “প্রমিত” নামে যে ভাষাটি প্রথমে লিখলাম সেটা বাংলাদেশের কোন জেলার ভাষা? চলুন খুঁজে এ প্রশ্নের জবাব-
ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। যেহেতু বিশ্বে সম্ভবত আমরাই একমাত্র (?) ভাষার জন্যে লড়াই করেছি এবং এর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে রক্ত দিয়েছি, তাই অন্য বহুবিধ বিষয়ে গর্ব করতে না পারলেও, ‘বাংলা ভাষা’র জন্যে গর্ব করতে কিন্তু আমরা কখনোই পিছনা হইনা। এর কারণও অবোধ্য নয়! যারা সারা বছর কষ্টে-সৃষ্টে জীবন কাটান, তাদের জীবনে ‘ঈদ’ মহা খুশি নিয়ে আসলেও, সারা বছর ‘ঈদ পালনকারি’ বিলাসি মানুষের কাছে ঈদ বা এই জাতিয় বাৎসরিক উৎসবের আনন্দময়তা ঠিক অতটা থাকেনা। তবুও এটা আমাদের ‘শ্লাঘা’র বিষয় যে, দৈন্যতাপূর্ণ আমাদের জীবনে ভাষা আন্দোলন ও ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা একটি মাইল ফলক কিন্তু!

কিন্তু আমরা জানি কি, যে ভাষার জন্যে আমরা (কোলকাতাবাসি নয়) জিবন দিয়েছি (এবং এ লেখাটি যে ভাষায় লিখছি), সে ভাষাটি কিন্তু ‘আমাদের নয়’? আমরা পূর্ববঙ্গিয় তথা বাংলাদেশের ৬৪-টি জেলার কোন মানুষই কখনো এ ভাষা বলা বা লেখায় ব্যবহার করতাম না, এমনকি জানতামও না। বঙ্গ বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশ অংশে পুরণো জেলা ছিল ১৭টি, যা বর্তমানে ৬৪টি। এই ৬৪টি জেলার কোন জেলার মানুষই কথা বলার জন্যে বর্তমান বাংলা ‘সাধু’ বা আধুনিক ‘চলিত’ ভাষা ব্যবহার করেনি। উদাহরণ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। টেকনাফের লোকেরা কি ‘সাধু’ বা ‘চলিত’ বা আধুনিক ‘কথ্য’ বাংলা ভাষায় কথা বলে? আসলে বলে না। তারা ‘চট্টগ্রাম’ ও ‘আরাকানি মিশ্র’ ভাষা ব্যবহার করে। তেতুলিয়ার লোকের উত্তরবঙ্গিয় ঢংয়ে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। পশ্চিম-দক্ষিণের খুলনা? সেখানের মানুষের ভাষাও আলাদা খুলনা কেন্দ্রিক একটি আলাদা ভাষা। আর আমরা সবাই জানি সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকাইয়া, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি জেলার ভাষাগুলোর মধ্যে রূপমূলগত ও ব্যবহারিক পার্থক্য কত! এমনকি চট্টগ্রামের ভাষা ও ফেনীর ভাষা আলাদা হলেও চট্টগ্রামের ‘মিরেশ্বরাই’ উপজেলার ভাষা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বরিশালের ভাষার সঙ্গে নোয়াখালীর ভাষার পার্থক্য প্রকট হলেও, ‘ভোলা’র ভাষাটি আবার না-বরিশালি না-নোয়াখালি অর্থাৎ মিশ্র প্রকৃতির। এমনকি ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তি স্থানে অবস্থিত বরিশালভুক্ত ‘মেহেন্দিগঞ্জ’ উপজেলার মানুষের কথা শুনে কেউ বুঝতে পারবে না বক্তার বাড়ি বরিশাল, মাদারীপুর বা শরিয়তপুর। যেমন ‘আমি বাজার থেকে এসেছি’ বাক্যটি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মুই আডে গোনে আইছি’ হলেও, মেহেন্দিগঞ্জের উপভাষায় এটি ‘আমি বাজারের তোন আইছি’’ হয়। এটি হয়েছে ‘ভাষা জাংশন’-এর সূত্রানুসারে। এমনকি মেহেন্দিগঞ্জের ‘জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন’ ও ‘কাজিরচর’ গ্রাম খালের এপার ওপার হলেও ব্যবহৃত ভাষার রূপগত পার্থক্য সুষ্পষ্ট, যা ভাষা বিশ্লেষকদের গভিরভাবে চিস্তাশিল করবে।

মোদ্দা কথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক বিভাজন ৬৪-টি জেলার মধ্যে কমপক্ষে ৬৪-প্রজাতির (উপজেলা হিসেবে আরো বেশি হতে পারে) ভাষা ব্যবহৃত হলেও, যে ভাষাটিকে আমরা বর্তমানে ‘সাধু’ বা আধুনিক ‘চলিত’ ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছি, তা কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের কোন অঞ্চল বা জেলার ভাষাই নয়। এ ভাষাটি হচ্ছে ‘কোলকাতা’ শহর তথা সুতোনটি গ্রামের (এখন সেটা মধ্য কোলকাতার একটা মেট্রো ট্রেন স্টেশন) ও তার পার্শ্ববর্তি ‘ভাগিরথি নদি তীরবর্তি’ মানুষের মুখের ভাষা। যা বৃটিশ ভারতে প্রথমে কোলকাতা অঞ্চলে বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে সাহিত্যের ভাষা তথা ‘সাধু’ ভাষা হিসেবে প্রবেশ করে। পূর্ববঙ্গে তখনো ঐ ভাষাটির প্রবেশ ঘটেনি। এর পর যশোর থেকে ‘মাইগ্রেটেড’ কোলকাতার আরেক বনেদি অধিবাসি প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যমে কোলকাতা ও ভাগিরথি অঞ্চলের ‘কথ্য ভাষা’টি ‘আধুনিক বাংলা’ ভাষা হিসেবে সাহিত্যে স্থান করে নেয়। বৃটিশ ভারতে কোলকাতা যেহেতু ভারতবর্ষের রাজধানি ছিল, তাই রাজধানির প্রভাবশালি ভাষাটি কালক্রমে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, অফিস-আদালত, দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে উভয় বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম) মধ্যে বিস্তার লাভ করে। ‘উঁচু জাতে ওঠা’র সুপ্ত বাসনা লালনকারি ‘অকোলকাতা’-বাসি সাধারণ বাঙালিরা ‘গড্ডলিকা’র মত কোলকাতার ভাষাকে গ্রহণ করে এবং বাংলার সর্বত্র তা সাহিত্যের তথা ‘সাধু’ বা ‘শুদ্ধ’ বাংলা হিসেবে লালিত হয়। ‘অকোলকাতা’র আঞ্চলিক বাংলা প্রায় সকল স্থানে এখনো মুখে মুখে রক্ষিত হলেও, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার প্রায় সকল মানুষ কোলকাতার ভাষাটিকে ‘নিজস্ব বাংলা’ বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ‘কোলকাতার বাংলা’ ভাষাটি সকল বাঙালি কর্তৃক গ্রহণের নেপথ্যে কাজ করেছিল প্রথমত রাজধানি কোলকাতার আধিপত্য ও বনেদিপনা। তা ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির কেন্দ্রবিন্দুও কোলকাতা কেন্দ্রিক হওয়া। অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর মত প্রভাবশালি শিক্ষিত জমিদার ব্যক্তিদ্বয়ের বসবাস কোলকাতা হওয়াতে, তারাও তাদের মুখের ভাষাটিকে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে প্রভাব ফেলেছে দারুণভাবে। এ ক্ষেত্রে যদি ভারতবর্ষের রাজধানি ‘কোলকাতা’ না হয়ে ‘বরিশাল’ বা ‘সিলেট’ হতো এবং রবীন্দ্রনাথ বা এই শ্রেণির সাহিত্যিকের জন্ম কোলকাতা না হয়ে বরিশাল বা সিলেট হতো, তবে হয়তো বরিশাল বা সিলেটের ভায়াটিই আধুনিক বাংলা ‘সাধু’ বা ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে দুই বাংলার সর্বত্র গৃহিত হতো।


তবে শুধু আমরা জেনে রাখলাম, বাংলাদেশের অনেক ‘আমদানি’কৃত জিনিসের মত আমাদের আধুনিক বাংলাটিও কোলকাতার মানুষের ব্যবহৃত ও তাদের মুখের ভাষা থেকে এদেশে ‘আমদানিকৃত’, যদিও বাংলাভাষি মানুষেরা সবসময়ই রাজভাষা হিসেবে অন্যের ভাষা ব্যবহার করেছে শতাব্দির পর শতাব্দি। সে কারণেই হয়তো এখনো আমাদের বিদেশি জিনিসের প্রতি এতো মোহ। এদেশের বাঙালিরা তেইশ বছর রাজভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে উর্দু, দু’শ বছর ইরেজি, সাড়ে পাঁচ’শ বছর ফার্সি, তার আগে বহিরাগত ভাষা সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, কামরূপি আরো কত কি? এখনো আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা কারো সিলেটি, চট্টগ্রামি, ঢাকাইয়া বা বরিশালি। কিন্তু তা সত্বেও কোলকাতার ভাষাকে সত্যিই আমরা আমাদের ‘মাতৃভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং বিশ্বে সম্ভবত আমরাই এমন একটি ‘ধার’ করা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি। যে কারণে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগুলো ছাড়াও কোলকাতাবাসিগণও আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ‘শ্রদ্ধা’ এবং শ্রদ্ধার সাথে কিঞ্চিৎ ‘ঈর্ষা’ও করে। অতএব বোঝা গেল রাজনৈতিক বাংলাদেশ তথা পূর্ববাংলার মানুষেরা একুশ ফেব্রুয়ারি যে ভাষাটির জন্য রক্ত দিয়েছিল তা তার নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষা নয়, এটা ছিল কোলকাতা অঞ্চলের অভিজাত বনেদি মানুষের ভাষা তথা রাজধানির ভাষা, যা এদেশের বাঙালিরা আত্মিকরণ করে অনেক বিদেশি জিনিসপত্র আত্মিকরণের মতই! এখন যাকে সে মর্যাদা দিচ্ছে তার মাতৃভাষা রূপে। কিন্তু তা দিলেও, ভাষাটি তার নিজের মায়ের ভাষা [এমনকি পিতৃভাষাও না] না হওয়ার কারণে, সে তাকে এখনো ‘পরভাষা’ করে রেখেছে দেশের উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরত্বপূর্ণ কর্ম তথা স্থানেই। তাই বাংলা “অপাঙ্‌ক্তেয়” ভাষা-ই রয়ে গেল ২০১৪ সনেও রাজনৈতিক বাংলাদেশে এসব ঐতিহাসিক অকথিত অপ্রিয় সত্যের কারণে!







‘টিপাইমুখ’ ‘বরাক-টুইবাই’ এবং বাংলাদেশ ভারত জলবণ্টন সমস্যার স্বরূপ অন্বেেষা ! প্রবন্ধ # ৪৪



বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এ বন্যার নানাবিধ কারণ থাকলেও, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও তাদের মিডিয়াগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে সাধারণ অনেক বংলাদেশী শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করে যে, ‘‘বর্ষা মৌসুমে ভারত ফারাক্কা বঁাধ খুলে দিয়ে, তাদের দেশের অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে, যেমন শুকিয়ে মারছে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়ে পর্যাপ্ত পানি আসতে না দিয়ে’’। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ প্রকল্প। ভারত বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারে অনেক বাংলাদেশী মনে করতে শুরু করেছে যে, ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ আরেকটি ‘ফারাক্কা’ যা মূলত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নতুন ষড়যন্ত্র। আর এ বিশ্বাসের কারণে অনেক বাংলাদেশী মানুষ ভারতকে তাদের প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ দেশের পরিবর্তে ‘শত্রু’ দেশ হিসেনে মনে করে থাকে, যদিও যৌক্তিকভাবে কথাটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু। আর এ সত্যতা বিশ্লেষণে বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যায় ভারতকে কতটুকু ‘দোষী’ করা যায়, তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। দেখা যাক, ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে।

প্রথমে দেখা যাক শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি স্বল্পতা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হয়না, শীতের কারণে গঙ্গার উৎসস্থল ‘হিমালয়ে’ বরফ জমে থাকে, তাই সঙ্গত কারণেই ঐ সময়ে জল-প্রবাহ দু’অঞ্চলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে বিধায়, কোন অঞ্চলই তার চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সরবরাহ ঐ সময় পায়না। আর পানি প্রবাহের স্বল্পতার কারণে ভারত যদি ঐ সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তার চাহিদা মোতাবেক পানি ধরে না রাখে, তবে তার দেশের সেচ সুবিধা ছাড়াও কোলকাতা বন্দর বন্ধের উপক্রম হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, ঐ সময় বাংলাদেশেও পানি স্বল্পতার কারণে তাদের চাহিদামত পানি পায়না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হচ্ছে চাহিদামত ‘যোগান’ না থাকলে একটি পরিবারও কম বা পরিমিত বন্টনের নীতি গ্রহণ করে, কম ভোগের মাধ্যমে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও শুকনো মৌসুমে পানির ‘যোগান’ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় ‘কম’ থাকাতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে ‘পরিমিত’ বন্টনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে এটিই যৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তির ধারে-কাছে না গিয়ে আমাদের ভারত বিদ্বেষী ইসলামের নামধারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাংলাদেশীদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে, যদিও ইসলামে সেচ ও পানি স্বল্পতা হলে করণীয় সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফে’ সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিম্নরূপভাবেঃ

মদিনার কৃষি জমিতে জনৈক মক্কাবাসী ও মদিনাবাসীর মধ্যে পানিসেচ নিয়ে বিবাদ শুরু হলে ইসলামের নবী মহাম্মদ নির্দেশ দিলেন, ‘‘যার জমি উঁচুতে ও প্রথম শুরু হয়েছে, সে পর্যাপ্ত পানি নেয়ার পরই পরবর্তী জমির মালিক পানি সেচের সুবিধা পাবে’’-(সূত্রঃ বোখারী শরীফে হাদিস নং ২১৮৮ ও ২১৮৯) এই হাদিস ব্যাখ্যা করলে উচঁু তথা উজানে তথা উৎসমূলে ভারতের অবস্থান বিধায় বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ ভারতের ‘পর্যাপ্ত’ জল-চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশকে দেয়ার মত ‘পর্যাপ্ত’ পানি কি আর শুকেনো মৌসুমে অবশিষ্ট থাকে? একজন বাংলাদেশী হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের অমৌলবাদী শিিক্ষত মানুষদের উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই।

আর বর্ষার বন্যার ব্যাপারে এখন প্রায় সকল পানি বিশেষজ্ঞ একমত যে, ‘গ্রিনহাউস’ ইফেক্ট তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনামসহ সাগরপারের অনেক দেশই এখন প্রতি বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যার জন্যে যেমন ভারত দায়ী নয়, তেমনি ভারতে বন্যার জন্যে দায়ী নয় চীন কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবী হচ্ছে, ‘ভারত কেন বর্ষা মৌসুমে পানি না আটকিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারছে’? তাহলে ভারত কি বর্ষার প্রচুর বন্যার ঢল আটকে রেখে তাদের দেশকে ডুবিয়ে মারবে? এমনকি তাদের কোলকাতা বন্দর ডুবে গেলেও? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের স্থানে হলে কি তাই করতো?

এবার দেখা যাক সাম্প্রতিক ইস্যু ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রসঙ্গে। ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা ও সম্প্রতি বাংলাদেশের ঘুরে আসা ‘সংসদীয় কমিটি’ থেকে যে সকল তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়, এ উপমহাদেশের হিমালয়ের নদীগুলোতে কেবল ভারত নয়, অন্যান্য বেশ কয়েকটি ‘দেশ’ তৈরী করছে তাদের সুবিধামত ‘জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প’। ভারত ছাড়াও পাকিসত্মান মোট ৩৫টি, নেপাল ৫৪টি, ভুটান ২১টি এবং চীন তৈরী করছে অসংখ্য জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প, যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে মাত্র ১টি (কাপ্তাই)। অর্থাৎ চীন বাদে বর্ণিত দেশ ক’টি সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার দেশের সমগ্র এলাকা জুড়ে মোট ৪২৯টি জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিলেও ‘টিপাইমুখ’ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২১০ কিমি দূরত্বে ‘বরাক-টুইবাই’ নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে ভারত এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে ভাটিতে নয় বরং ভারতের উজানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের মত শুকনো মৌসুমে পানি আটকে সেচ বা কোলকাতা বন্দর চালু রাখার কোন প্রকল্প নয়, এটি হচ্ছে শুকনো ও বর্ষা মৌসুমে মানে সব ঋতুতে সম পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রকল্পের ‘টারবাইনগুলো’ সচল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা।

এ ক্ষেত্রে ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিভাবে? বরং ভারতকে তার প্রকল্পের নিজস্ব স্বার্থেই সব ঋতুতে যেহেতু পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সে ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি প্রবাহের সুবিধা পাবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বাঁধ চালু হলে ‘টিপাইমুখের’ উজানে বরং কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির কারণে অনেক জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেমন ভারতের ‘উত্তরখন্ডে’ ১-হাজার মেঘাওয়াটের জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কারণে ‘ডেইরী’ শহরসহ ৩৭টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার নেপালের ‘কালিগন্ডকী’ প্রকল্পের কারণে হিন্দু তীর্থস্থান ‘শালগ্রাম শিলা’র একই পরিণতি হয়েছে। যেমন আমাদের ‘কাপ্তাই’ বাঁধের কারণে যেভাবে কাপ্তাই হৃদের সৃষ্টি হয়েক্ষতি হয়েছিল ‘চাকমা’ জনবসতি। বর্ণিত জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাটিতে কিন্তু কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় আনা উচিত ভারত যা করছে তা কি আমাদের ক্ষতির জন্যে? নাকি তার দেশের চাহিদার জন্যে? ভারতে এখন বিদ্যুৎ চাহিদা ১লাখ ৮ হাজার ৮৮৬ মেঘাওয়াট, যার মধ্যে বর্তমান ঘাটতি ১৮ হাজার ৯৩ মেঘাওয়াট। ভারত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করছে আগামী দিনগুলোতে সে জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ১,২৬,৫৮৮ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যদিও সে এখন উৎপাদন করছে মাত্র ১৯,৬৪১ মেঘাওয়াট। হ্যা, আন্তদেশীয় অভিন্ন নদীগুলোর এক তরফা পানি প্রত্যাহার হলে সংশিøষ্ট দেশক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আমাদের ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠী তৎপর হলেও চীন সম্প্রতি তাদের ‘সাংপো’ (আমাদের ব্রম্মপুত্র) নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা করছে সে ব্যাপারে আমাদের দেশের কেউ কিন্তু আপাত কোন কথা বলছে না।


এ ব্যাপারে আমাদের উচিত বাস্তবায়তায় ফিরে আসা। ভারত যখন তার দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ‘পিয়াজ’ বা ‘চাল’ রপ্তানী বন্ধ করে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পিয়াজ/চালের দাম বেড়ে যায়, তখন আমরা ‘ভারত আমাদের পিয়াজ/চাল রপ্তানী বন্ধ করে কষ্ট দিতে চাইছে’ বলি কিন্তু বলিনা যে, আমাদের নিজেদের পিয়াজ ও চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত থেকে যেন আমদানী করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের উত্তরাঞ্চলে বড় বড় ‘জলাধার’ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধের জন্যে ‘ড্রেজিং’ করে আমাদের নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা না করে আমরা যদি কেবল ভারতকে ‘গালি’ দিতে থাকি এবং ‘হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা’ বলে ভারতকে খ্যাপাতে থাকি, তবে কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? কেবল ভারতের সঙ্গে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের পানি বন্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা মূলত ভারতেরও একটি অন্যতম সমস্যা। বুখারী শরীফের হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারত যদি আমাদের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তবে আমরা কি করবো চিন্তা করে দেখা দরকার।








মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৪০-বছরের ভারত-বাংলাদেশ বৈরিতা : সমাধান কোন পথে? [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৪৩ ]



গত বছর কোলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সিতে ভ্রমণকালে বাংলাভাষী ট্যাক্সিওয়ালার খেদোক্তি ছিল, ‘‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রায় ২০,০০০ সেনার রক্তে বাংলাদেশ রঞ্জিত হলেও এবং তখনকার অভাবী কোলকাতার মানুষের বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন, আর ১-কোটি শরণার্থীকে নানাভাবে সহযোগিতার পরও, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কেন এতো ভারত-বিদ্বেষী? কেন বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে নানা কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারী সন্ত্রাসীদের সহায়তা করে? বাংলাদেশ কি পাকিস্তান’’?

এরূপ অভিযোগ আরো শুনেছি হিন্দীভাষী চেন্নাইগামী ট্রেনযাত্রীর মুখে ‘করোমন্ডল এক্সপ্রেসে’। যদিও কোলকাতার অধিকাংশ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির ব্যাপারে খুবই ‘নস্টালজিক’ এবং পশ্চিম বঙ্গের মতই তারা মনেপ্রাণে রাজনৈতিক বাংলাদেশকে ভালবাসে, বিশেষ করে এক সময় যাদের পূর্বপুরুষরা বাস করতো পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে। সুসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত মানুষেরাও তিস্তার পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে সহাস্যে যখন ’বাংলাদেশকে সব দিয়ে দিতে বলেন’ তখন এদেশের জন্যে তাদের হৃদ-উৎসারিত অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশিত হতে দেখে বাঙলাদেশি হিসেবে আমি আপ্লুত হই। কোলকাতার ট্যাক্সিওয়ালা কিংবা হিন্দীভাষী ট্রেনযাত্রীর প্রশ্ন আমাকে দারুণভাকে ভাবিয়ে তোলে। হ্যা, যে দেশটি ন’মাস ভূমিধ্বস সহযোগিতা করে, পাকিস্তান তথা আমেরিকা প্লাস চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে একটি দেশের স্বাধীনতার ফুল ফোটাতে সাহায্য করেছিল, ঘরে বাইরে করেছিল নানাবিধ সহযোগিতা, তার ব্যাপারে কেন এদেশের কোটি কোটি মানুষের নেতিবাচক ধারণা? বিষয়টির একটু গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে।

চলমান সমূয়ে ভারত নানাভাবে সন্ত্রাসী আক্রান্ত আর আতংকিত একটি দেশ। একদিকে জন্ম থেকেই চিরশত্রু পাকিস্তান অপর দিকে চীন, পূর্ব সীমান্তের সামরিক শাসনাধীন ‘মায়ানমার’ আবার চীনের ধামাধরা। প্রায়ই দেশটিতে নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটে থাকে, যার কয়েকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ নিম্নরূপঃ

১৮/৬/২০০০ তারিখ ভারতের কেল্লার মোড়ে জোড়া বিস্ফোরণ, ১৩/১২/২০০১ ভারতের সংসদে ৫ জঙ্গী ঢুকে হত্যা করে ১২ জনকে, ২৫/১০/২০০৫ ভারতের ৩ শহরে বিস্ফোরণ নিহত ৫৯, ১৩/৯/২০০৮ কনট প্লেস, করোলবাগ ও গ্রেটার কৈলাস বিস্ফোরণ ও নিহত ২৫, ২৭/৯/২০০৮ কুতুব মিনারের কাছে ফুলবাজারে বিস্ফোরণে নিহত ৩, তাজমহল হোটেলে প্রকাশ্যে ফায়ার ফাইট ও বিষ্ফোরণে হুজির সমর্থনদাতা হিসেবে পাকিস্তানের আইএসআই ছাড়াও বিগত সরকারগুলোর সময় বাংলাদেশের ডিজিএফআই-এর দিকেও অভিযোগ তুলতো ভারত। যদিও ভারত এখনো বের করতে পারেনি, বার বার কাদের অর্থে ও নেতৃত্বে ভারতে বড় আকারের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক দিল্লি হাইকোর্টে আক্রমনে হুজি বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আবিস্কৃত হয়েছে ‘এনআইএ’-সহ ভারতীয় নানা মাধ্যমে।

ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। অনেক সমালোচক ও বুদ্ধিজীবীই এখন বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে ভারতের অনেক চ্যানেল দেখানো হলেও, ভারতে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো দেখানো হয়না। কথাটি কতটুকু সত্য আলোচনা করা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক ভারত কিংবা বাংলাদেশে বিশ্বের ২-৪টি নিষিদ্ধ (পর্ন বা এই শ্রেণির) চ্যানেল ছাড়া পৃথিবীর সব চ্যানেলই উন্মুক্ত। বাংলাদেশের ক্যাবল ব্যবসায়ীরা এদেশের জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে স্টার-প্লাস, সনি, জি-বাংলা ইত্যাদি চ্যানেল প্রর্দশন করছে। এটি ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কোন উদ্যোগ নয়। বর্ণিত ভারতীয় চ্যানেল না দেখানো হলে, আমাদের অনেক মধ্যবিত্তই হয়তো ‘ক্যাবল কানেকশন’ রাখবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী মায়ানমার বা ভুটানের কোন চ্যানেল বাংলাদেশের মানুষেরা দেখতে চাচ্ছেনা বলে এদেশের ক্যাবল অপারেটরা তা দেখাচ্ছে না। এর মানে বার্মার চ্যানেল কি এদেশে নিষিদ্ধ? আমরা কোলকাতাতে মার্কুইজ স্টিটের হোটেলগুলোতে বাংলাদেশী চ্যানেল দেখেছি। সম্ভব না হলে তারা দেখায় কিভাব? যেহেতু সেখানের হোটেলগুলোতে বাংলাদেশীরা থাকে বিধায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ ‘এটিএন বাংলা’সহ বাংলাদেশী কয়েকটি চ্যানেল চালাচ্ছেন। বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোতে অধিকাংশই এদেশের খবর ও রাজনৈতিক টক-শো থাকে বিধায়, ভারতীয়রা তা দেখতে খুব আগ্রহী নয়, যেমন বাংলাদেশী দর্শকরাও ভারতীয় খবর ও টকশো খুব একটা পছন্দ করেনা, যেমনটি করে বর্ণিত চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয় সিরিয়াল, হাসির অনুষ্ঠান, মীরাক্কেল, তারা মিউজিক, কোনবনেগাক্রোরপতি, আপকা কাচারীর মত মান সম্মত অনুষ্ঠান। আমাদের চ্যানেলগুলো ঐ মানের অনুষ্ঠান তৈরী করলে, অবশ্যই ভারতীয়রা তাদের নিজের গরজে দেখবে আমাদের চ্যানেল। এদেশের অপারেটররা এখন ‘পিটিভি’ কিংবা ‘সৌদি টিভি’ দেখালেও ক’জন দর্শক তা দেখে?

আরেকটি অভিযোগ করা হয়ে থাকে ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃৃক ভিসা প্রদানে হয়রাণি ও কড়াকড়ি, কথাটি সত্য। আসলে বর্তমান জালিয়াত ও সন্ত্রাসী বিশ্বে কড়াকড়ি ছাড়া কেউই বাংলাদেশীদের ভিসা দিতে চায়না। যারা ইউরোপ-আমেরিকার ভিসা চেয়েছেন তারা জানেন ‘ভিসাপ্রাপ্তি কাকে বলে’? আমি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বৃটেন ভ্রমণ করে দেখেছি ভিসা জটিলতা কত। আসলে সব দেশই বাংলাদেশীদের ব্যাপারে কড়াকড়ি করলেও, বদনামটি কেবল ভারতের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় দূতাবাসের বক্তব্য হচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় ২০০০ বাংলাদেশীকে ভারতীয় ভিসা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যা পৃথিবীর সকল ভারতীয় দূতাবাসগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে সীমান্তে মানুষ বা বাংলাদেশী হত্যা। হ্যা ফেলানীর মত কিশোরীর মৃত্যু আমাদের সকলকে কাঁদায়। এটি সম্ভবত ভারত করে থাকে তার নিজের দেশের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধের জন্যে। যেহেতু জেএমবি-হুজিরা এখনো গভীর রাতেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়। আমাদের মত অসন্ত্রাসী মানুষরা কখনো গভীর রাতে সীমান্তে যাবে কি? ভারতীয় সীমান্তে রাতে ‘কারফিউ’ থাকা সত্বেও কারা সীমান্তে যায়? এটি নিন্দনীয় হলেও, ভারত যতদিন তার সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে চায়, ততদিন আমাদেরও রাতে তাদের সীমান্ত অবৈধ পাড়ি দেয়া বন্ধ করলে, তারা কি আমাদের ঘরে এসে আমাদের হত্যা করবে? একটি জরীপে দেখা গেছে, ভারতীয় সীমান্তে গড়ে বছরে ১০০ বাংলাদেশী হত্যা করা হয়। কিন্তু আমরা নিজেরা সড়ক দুর্ঘটনার নামে প্রত্যহ গড়ে ৫০ জন বাংলাদেশী মানুষ হত্যা করছি তা কি জানি?

সরব গলায় আরেকটি কথা বলা হয়ে থাকে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির কথা। আসলে ভারতের চেয়ে অনেক বেশী বাণিজ্য ঘাটতি আমাদের চীনের সঙ্গে যা প্রায় ৯২%। চীন বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানীতে প্রথম, তারপরও চীনা কোম্পানীগুলো আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিকম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারী কাজ পায় ঠিকই। এমনকি চীন ব্রহ্মপুত্র নদীকে ব্যাপক বাঁধ দিয়ে যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানাচ্ছে তা কি বাংলাদেশে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে? না সে কথা আমরা খুব একটা বলছি না যতটা বলছি ভারতের ব্যাপারে।

আসলে বাংলাদেশ হচ্ছে একটি আমদানী নির্ভর দেশ। আমাদের ভোগ্যপণ্যের খুব কমই আমরা উৎপাদন করতে পারি, অধিকাংশ জিনিসই আমাদের আমদানী করতে হয়। আমাদের গাড়ি অধিকাংশ আনা হয় জাপান থেকে। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স মালপত্র অধিকাংশ চীন থেকে। পেয়াজ, রসুন, আদা, জিরা ইত্যাদি হাজারো নিত্য ভোগ্যপণ্য কেনা হয় ভারত থেকে। কিন্তু আমাদের রপ্তানী পণ্য খুব কম। যারা যে পণ্য উৎপাদন করে তারা সাধারণত ঐ পণ্যটি তার দেশে প্রবেশ করতে দেয়না। বাংলাদেশ ‘গার্মেন্টস’ বা ‘ইলিশ মাছ’ উৎপাদন করে বিধায় ঐ দুটো পণ্য কি বাংলাদেশে আমদানী করার অবাধ স্বাধীনতা কাউকে দেবে? যেমন দেবে না জাপান তার দেশে কাউকে গাড়ি আমদানী করতে। চীন দেবেনা তার দেশে উৎপাদিত হয় এমন পণ্য কোন চীনা কোম্পানীকে আমদানী করতে। ভারত এখন প্রায় সকল ভোগ্য পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। তারা বলতে গেলে নিজেরাই এখন প্রায় সব পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানী করে। এখন কোন যুক্তিতে তারা তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশ থেকে শুল্কমুক্তভাবে ভেতরে ঢুকতে দেবে? কিন্তু এমন কোন পণ্য কি আছে যা কেবল বাংলাদেশ উৎপাদন করে কিন্তু ভারত করতে পারেনা? হ্যা, ভারত যাত্রীবাহী বিমান আমদানী করে কিন্তু বাংলাদেশ কি তা ভারতের কাছে রপ্তানী করার ক্ষমতা রাখে? কাজেই আজকের বিশ্বের বাস্তবতার যুক্তিতে বাংলাদেশ ভারত বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি আপেক্ষিক। এটি কমবে যেদিন বাংলাদেশে নিজেরা তার নিত্যপণ্য উৎপাদন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, আর পেয়াজ রসুন, হলুদ মরিচ ভারত থেকে আমদানী করতে হবে না।

আসলে পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুতে হত্যার পর এদেশের বিভিন্ন শাসকরা নানাভাবে প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার, ভারত বিদ্বেষী সন্ত্রাসীদের লালন ও মদদ প্রদান করেছে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে। ৩০ বছরের অপশাসনে এন্টি-ভারত ও এন্টি-আওয়ামী লীগ প্রচারণা চলছিল অব্যাহত ধারায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হালমার জন্য ভারতকে সরাসরি দায়ী করেছিলেন আমাদের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব। পুরুলিয়ার অস্ত্র ফেলার রেশ না কাটতেই, আবার ১০ ট্রাক অস্ত্র আনা হলো ভারতের বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমান্ত বিরোধ ও হত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, পানির বঞ্চনা, বাণিজ্য ঘাটতি, বর্ষায় পানি ঠেলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ।

এদেশের বন্যার নানাবিধ কারণ থাকলেও, ভারত বিরোধী পক্ষ ও তাদের মিডিয়াগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে সাধারণ অনেক বংলাদেশী শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করে যে, ‘‘বর্ষা মৌসুমে ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে, তাদের দেশের অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে, যেমন শুকিয়ে মারছে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়ে পর্যাপ্ত পানি আসতে না দিয়ে’’। এর সঙ্গে তারা যুক্ত করছে ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রকল্প। ভারত বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারে অনেক বাংলাদেশী মনে করে যে, ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ আরেকটি ‘ফারাক্কা’ যা মূলত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নতুন ষড়যন্ত্র। আর এ বিশ্বাসের কারণে অনেক বাংলাদেশী মানুষ ভারতকে তাদের প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ দেশের পরিবর্তে ‘শত্রু’ দেশ হিসেনে মনে করে থাকে, যদিও যৌক্তিকভাবে কথাটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু।

সাম্প্রতিক শেখ হাসিনা-মনমোহন চুক্তিতে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, সীমান্ত প্রটোকল, ৪৬-পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ, ৩-বিঘা ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা, বাংলাদেশী পণ্য নেপাল- ভুটানে যাওয়ার ট্রানজিট, ছিটমহল সমস্যার চুক্তি হয়েছে। ভারতীয় ৮৫/২০১১ নং প্রজ্ঞাপনে ৪৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত হওয়াতে বাংলাদেশ যেমন উৎফুল্ল হয়েছে, তেমনি গোস্বা হয়েছে মুম্বাই ও দিল্লির গার্মেন্টস শিল্প মালিকগণ, যার মধ্যে ২৪টি নিটওয়ার, ২১টি ওভেন ও ১টি সিল্ক ফেব্রিক্স, যা সবই ভারত নিজেরা উৎপাদন করে। ভারতের পোশাক শিল্প মালিকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় মনমোহন সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে (এ জন্যই কি নির্বাচনে এমন ফলাফল?)।

ভারত তার ১১১ ছিটমহল বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বিনিময়ে কোনরূপ পূর্বশর্ত বা ক্ষতিপুরণ ছাড়াই প্রায় ৭০০০ একর অতিরিক্ত জমিসহ বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। তা ছাড়া বিতর্কিত ৪ কিমি এলাকা (ত্রিপুরার মুহুরী নদী এলাকা, পশ্চিমবঙ্গের দাইকাটা, করিমগঞ্জের লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি) ভারত দাবী করেনি। বিগত যৌথ জরীপ ও অপদখীয় ভূমি হস্তান্তরের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ পাবে ২৬৭ একর, আর ভারত পাচ্ছে ২৬১ একর। যদিও এখনো আসামের ৪৮৫ একর ভূমি অমিমাংসিত রয়েছে। আসামের ৬০০ একর বাংলাদেশ পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ জমি নিয়ে ২০০১ সনে বিডিআর-বিএসএফ সীমান্ত সংঘর্ষে ১৬-জন বিএসএফ প্রাণ হারায়। করিমগঞ্জের ৩৬৪ একর জমি বাংলাদেশকে দেয়াতে, ইতোমধ্যেই আসামের বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কংগ্রেস ও মুখ্য মন্ত্রী গগৈর বিরুদ্ধে নানাবিধ কর্মকান্ড শুরু করেছে। আসামের ধুবড়ী জেলার বড়াইবাড়ি সীমান্তের বিতর্কিত ১৯৩ একর জমি পেয়েছে বাংলাদেশ। যা নিয়ে আসামে এখন আন্দোলন তুঙ্গে। আসামীরা একে বিশ্বাসঘাতকতার চুক্তি বলছেন।


আমরা এ অঞ্চলে ৪০-বছরে সার্কের ভূমিকা দেখেছি প্রায় শূন্য। যেখানে আশিয়ানদের মধ্যে সড়ক, ট্রেন, সব উন্মুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জিসিসির মত ভারত-বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও ২-দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরী, যাতে চুক্তি বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করে এবং ১৯৭২-৭৪ সনে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন সহজ হয়। অনেকেই মমতাকে ‘ড্রামা কুইন’ বলেন। তিনি তিস্তার পানি মাপার কথা বলছেন, মমতার শিক্ষা ‘‘দেশের স্বার্থ সবার আগে’’। ভারতের থেকে দেশপ্রেম শিক্ষণীয় আমাদের কারণ আমাদেরই পত্রিকারই খবর, রেলের ৫০-হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়েছে আমাদের ভূমিদস্যুদের হাতে।

অনেকেই বলেন, ট্রানজিট আমাদের ‘ট্রাম-কার্ড’ কিন্তু তিস্তা বা অন্য ৫৩টি নদীর পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যা। ভারতের কাছে না চেয়ে বরং আমাদের ‘ন্যায্য হিস্যা’ আদায়ের জন্যে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে। কিন্তু আমার জানা নেই, এমন কোন ‘আন্তর্জাতিক ফোরাম’ বাংলাদেশের পক্ষে আছে কিনা, যারা ২-দেশের অভিন্ন নদীর পানি এককভাবে ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের জন্যে বরাদ্দ করবে। আসলে এমন কোন ফোরাম নেই, এগুলো শুধু কথার ফানুস, যা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসলে বুঝতে হবে, তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিম তথা ১টি হ্রদে। বাংলাদেশের মত তিস্তার পানি আসলে নদী অববাহিকার সকল মানুষের ন্যায্য হিস্যা। একইভাবে ভারতীয়দের কাছে গঙ্গা পবিত্র। গঙ্গার পানি উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কৃষকরা ব্যবহারের পর ভাটিতে দেয়ার মত পানি থাকে খুব কম বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। এ ক্ষেত্রে ‘সাপস্নাই’ কম কিন্তু ‘ডিমান্ড’ বেশী বলে ‘রেশনিং’ তথা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যে বের করতে হবে কল্যাণকর কোন পথ, যার কথা বলছেন মনমোহন ও হাসিনা সরকার। এক্ষেত্রে আমাদের কথাবার্তায় ভারত বৈরিতা পরিহারের মাধ্যমে আমরা সীমান্তে বিরোধ, ফারাক্কা পানির বঞ্চনা, বাণিজ্য ঘাটতি, বর্ষায় বন্যা ইত্যাদি সমাধানে এগিয়ে আসতে পারি। যেমনটি সম্প্রতি করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে মাল পরিবহনে সহযোগিতার জন্যে ‘বাংলাদেশের কাছে ঋণী’ বলে তথা ‘ঋণ স্বীকার করে’।

এবার দেখা যেতে পারে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি স্বল্পতা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হয়না, শীতের কারণে গঙ্গার উৎসস্থল ‘হিমালয়ে’ বরফ জমে থাকে, তাই সঙ্গত কারণেই ঐ সময়ে জল-প্রবাহ দু’অঞ্চলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে বিধায়, কোন অঞ্চলই তার চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সরবরাহ ঐ সময় পায়না। আর পানি প্রবাহের স্বল্পতার কারণে ভারত যদি ঐ সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তার চাহিদা মোতাবেক পানি ধরে না রাখে, তবে তার দেশের সেচ সুবিধা ছাড়াও কোলকাতা বন্দর বন্ধের উপক্রম হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, ঐ সময় বাংলাদেশেও পানি স্বল্পতার কারণে তাদের চাহিদামত পানি পায়না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হচ্ছে চাহিদামত ‘যোগান’ না থাকলে একটি পরিবারও কম বা পরিমিত বন্টণ তথা ‘রেশন-নীতি’ গ্রহণ করে, কম ভোগের মাধ্যমে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও শুকনো মৌসুমে পানির ‘যোগান’ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় ‘কম’ থাকাতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে ‘পরিমিত’ বন্টনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে এটিই যৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তির ধারে-কাছে না গিয়ে আমাদের ভারত বিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাংলাদেশীদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে, যদিও ইসলামে সেচ ও পানি স্বল্পতা হলে করণীয় সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফে’ সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিম্নরূপভাবেঃ


মদিনার কৃষি জমিতে জনৈক মক্কাবাসী ও মদিনাবাসীর মধ্যে পানিসেচ নিয়ে বিবাদ শুরু হলে ইসলামের নবী মহাম্মদ (সঃ) নির্দেশ দিলেন, ‘‘যার জমি উঁচুতে ও প্রথম শুরু হয়েছে, সে পর্যাপ্ত পানি নেয়ার পরই পরবর্তী জমির মালিক পানি সেচের সুবিধা পাবে’’-(সূত্রঃ বোখারী শরীফে হাদিস নং ২১৮৮ ও ২১৮৯) এই হাদিস ব্যাখ্যা করলে উচুঁ তথা উজানে তথা উৎসমূলে ভারতের অবস্থান বিধায় বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ ভারতের ‘পর্যাপ্ত’ জল-চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশকে দেয়ার মত ‘পর্যাপ্ত’ পানি কি আর শুকেনো মৌসুমে অবশিষ্ট থাকে? একজন বাংলাদেশী হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী শিক্ষেত মানুষদের উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই।

আর বর্ষার বন্যার ব্যাপারে এখন প্রায় সকল পানি বিশেষজ্ঞ একমত যে, ‘গ্রিনহাউস’ ইফেক্ট তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনামসহ সাগরপারের অনেক দেশই এখন প্রতি বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যার জন্যে যেমন ভারত দায়ী নয়, তেমনি ভারতে বন্যার জন্যে দায়ী নয় চীন কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠীর দাবী হচ্ছে, ‘ভারত কেন বর্ষা মৌসুমে পানি না আটকিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারছে’? তাহলে ভারত কি বর্ষার প্রচুর বন্যার ঢল আটকে রেখে তাদের দেশকে ডুবিয়ে মারবে? এমনকি তাদের কোলকাতা বন্দর ডুবে গেলেও? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের স্থানে হলে কি তাই করতো?

দেখা যাক সাম্প্রতিক ইস্যু ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রসঙ্গে। এ উপমহাদেশের হিমালয়ের নদীগুলোতে কেবল ভারত নয়, অন্যান্য বেশ কয়েকটি ‘দেশ’ তৈরী করছে তাদের সুবিধামত ‘জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প’। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান মোট ৩৫টি, নেপাল ৫৪টি, ভুটান ২১টি এবং চীন তৈরী করছে অসংখ্য জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প, যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে মাত্র ১টি (কাপ্তাই)। অর্থাৎ চীন বাদে বর্ণিত দেশ ক’টি সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মানে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার দেশের সমগ্র এলাকা জুড়ে মোট ৪২৯টি জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মধ্যে ‘টিপাইমুখ’ একটি। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২১০ কি.মি দূরত্বে ‘বরাক-টুইবাই’ নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে ভারত এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মানের পরিকল্পনা করছে। এ ক্ষেত্রে এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে ভাটিতে নয় বরং ভারতের উজানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের মত শুকনো মৌসুমে পানি আটকে সেচ বা কোলকাতা বন্দর চালু রাখার কোন প্রকল্প নয়, এটি হচ্ছে শুকনো ও বর্ষা মৌসুমে মানে সব ঋতুতে সম পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রকল্পের ‘টারবাইনগুলো’ সচল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিভাবে? বরং ভারতকে তার প্রকল্পের নিজস্ব স্বার্থেই সব ঋতুতে যেহেতু পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সে ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি প্রবাহের সুবিধা পাবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বাঁধ চালু হলে ‘টিপাইমুখের’ উজানে বরং কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির কারণে অনেক জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন প্রজেক্ট করবেন না।

এ ব্যাপারে আমাদের উচিত বাস্তবায়তায় ফিরে আসা। ভারত যখন তার দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ‘পিয়াজ’ বা ‘চাল’ রপ্তানী বন্ধ করে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পিয়াজ/চালের দাম বেড়ে যায়, তখন আমরা ‘ভারত আমাদের পিয়াজ/চাল রপ্তানী বন্ধ করে কষ্ট দিতে চাইছে’ বলি কিন্তু বলিনা যে, আমাদের নিজেদের পিয়াজ ও চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত থেকে যেন আমদানী করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের উত্তরাঞ্চলে বড় বড় ‘জলাধার’ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধের জন্যে ‘ড্রেজিং’ করে আমাদের নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা না করে আমরা যদি কেবল ভারতকে ‘গালি’ দিতে থাকি এবং ‘হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা’ বলে ভারতকে খ্যাপাতে থাকি, তবে কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? কেবল ভারতের সঙ্গে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের পানি বন্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা মূলত ভারতেরও একটি অন্যতম সমস্যা।

আসলে কাউকে ঠকানোর মনোবৃত্তি নিয়ে নিজ লক্ষে কখনো পৌঁছা যায় না। আমাদের উচিত হবে, ভারত থেকে প্রবাহিত ৫৪ নদীর পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্টনের আন্দোলন জোরদার করা, যাতে বাংলাদেশ-ভারত নির্বিশেষে নদী অববাহিকার সকল নদীনির্ভর মানুষগুলো তাদের জল-কেন্দ্রীক জীবনধারা সচল রাখতে পারে তার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। কাউকে বঞ্চিত করে, ঠকিয়ে কিংবা হটকারী কথাবার্তা না বলে সবার উপরে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা, যাতে গাঙ্গেয় অববাহিকার প্রাকৃতিক দুর্যোগনির্ভর এ জনগোষ্ঠীর মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটে ওঠে। নতুন মোদি সরকার কি চাইবেন প্রাক্তন কংগ্রেস সরকারের মতই তারা আন্তরিক বাংলাদেশ-ভারত সমস্যা সমাধানে। এ প্রত্যাশা থাকবে প্রত্যেকটি বাঙলাদেশির নতুন মোদি সরকারের প্রতি!



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত মানুষদের আত্মত্যাগ কি অকথিত-ই থাকবে? [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৪২ ]


হাজার বছরের চির পরাধীন এবং অবশেষে একাত্তরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মহান বিষয়ের ৪০-তম দিন পালনে আমরা এখন সবাই উদগ্রূীব। স্বাধীনতা অর্জনে ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ খেতাব ও কমবেশী সুযোগ সুবিধাও আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি স্বল্প সম্পদের এদেশে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা এখন বংশানুক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নাতিপুতিদের দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। ৭-জন বীর শ্রেষ্ঠর সম্মানে এদেশের মানুষ এখনো আপস্নুত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করেছি। শোনা যাচ্ছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশীদেরও সরকার সম্মানিত করবেন এবং সে লক্ষে একটি তালিকাও নাকি তৈরী হচ্ছে। যা সবই প্রশংসার দাবী রাখে। 

কিন্তু একটি ব্যাপার এদেশের অসাম্প্রদায়িক ‘কৃতজ্ঞ’ বাঙালিকে ‘দহন’ করছে প্রতিনিয়ত সেই একাত্তর থেকেই। আর তা হচ্ছে, একাত্তরে আমাদের চরম বিপদের সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল, তার স্মরণে কিংবা তারা কিভাবে কতটুকু আমাদের সহায়তা করেছিল তা সুষ্পষ্টভাবে সকল জাতির মাঝে কখনো ব্যাপক প্রচার না হওয়া। দীর্ঘদিন এদেশের মানুষ নানা প্রচার মাধ্যমে শুনে এসেছে, যুদ্ধের পর ভারত নাকি এদেশের অনেক সম্পদ ‘পাচার’ করে তাদের দেশে নিয়ে গেছে। এর সত্যা-সত্যও প্রকাশিত হওয়া দরকার ৪০-তম এ বিজয়ের প্রাক্কালে এ জাতির সামনেই।
আমরা যারা নিজ চোখে একাত্তর দেখেছি তারা কমবেশী জানি, পাকিস্তানীদের ভয়ে প্রায় কোটি শরণার্থী বাংলাদেশের ৩-দিকের বর্ডার দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের দেয়া হয়েছিল আশ্রয়, খাদ্য, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। কত মানুষের জন্যে ভারতের কত আশ্রয় কেন্দ্র ছিল সেখানে তার হিসেব কি আমরা কখনো করেছি? সরবরাহকৃত খাদ্য, ক্যাম্প আর অস্ত্রের পরিমান কি ছিল? এ ক্ষেত্রে ভারতের জনগণ কি ত্যাগ স্বীকার করেছিল এ জাতির স্বাধীনতায় বা ট্যাক্স দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্যে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিও কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে দান করেছিল বিনে পয়সায়? তার মূল্য ছিল কত? এ ছাড়া যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ডাকটিকেট, পোস্টার, মুদ্রা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল ভারত থেকেই। সরকারী দফতরও ছিল সেখানে। সেগুলো কিভাবে হয়েছিল?

একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে সরাসরি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সেক্টরে যুদ্ধে নামে। পাকিস্তানের মত একটি ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন ও চীনের সহায়তাপুষ্ট শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ভারতের কি কোন ক্ষতি হয় নি? আমাদের জানা ও বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে এ যুদ্ধে (বাংলাদেশ যুদ্ধে) ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট কত সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছিল? যার আর্থিক মূল্য কত? মানুষ ছাড়াও এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত অস্ত্র, বিমান, নৌ-জাহাজ ইত্যাদির পরিমান ও তার আর্থিক মূল্যমান কি আমরা বলতে পারবো? যুদ্ধে ভারতের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমান কি খুব নগণ্য ছিল?

ভারত ছাড়াও এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রকারে আমাদের সহায়তা দিয়েছিল? মানে অস্ত্র, অর্থ, কূটনৈতিক কিংবা অন্য আর কি কি ভাবে? যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানীদের রক্ষায় যখন বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ‘সপ্তম নৌবহর’ এলো বাংলাদেশের উপর আক্রমন চালাতে, তখন তা প্রতিরোধে সৌভিয়েত ৪০-জাহাজের পারমাণবিক নৌ-বহর ও ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ‘ভিক্রান্ত’ কিভাবে তার মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিল, তার ইতিহাস কি এদেশের শিশুরা জানবে না? স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী গঠনে ভারত কি কি বিমান ও নৌযান বাংলাদেশকে দান করেছিল, তাও প্রকাশিত হওয়া দরকার সত্য ইতিহাস সামনে আনার প্রয়াসে। 

আরো জানা দরকার, আত্মসমর্পনের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করার লক্ষে, পাকিস্তান নৌবাহিনী কর্তৃক পুরো বঙ্গোপসাগরে ‘অসংখ্য ভাসমান মাইন’ ছড়িয়ে দেয়ার গল্প এবং স্বাধীনতার পর তা উদ্ধারে এসে মাইন বিস্ফোরণে সৌভিয়েত নাবিকদের পতেঙ্গা সৈকতে নির্মম নিহত হওয়ার কাহিনী। নিহত এ সোভিয়েত সৈনিকরা হয়তো জন্ম নিয়েছিল লেনিনগ্রাদ বা ভারখয়োনস্কের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে, যারা অন্য এক অচেনা জাতির ‘মুক্তি সংগ্রামে’ এসে নিজের জীবনটি দান করলেন পতেঙ্গা সৈকতে! এদের সাহসের গল্প আমাদের না শোনালে, এ বীরত্বের কাহিনী আমাদের না জানালে, এদের স্মৃতিতে স্মৃতিশৌধ আমরা না বানালে, এদের আত্মত্যাগকে এ জাতি ‘স্যালুট’ না করলে, আমরা দিনের পর দিন ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতি থেকে একটি ‘কৃতঘ্ন’ জাতিতে পরিণত হবো না কি? আর এটি হলে কি ভবিষ্যত প্রজ্ন্ম আমাদের ক্ষমা করবে? কারন ‘অকৃতজ্ঞ’ ব্যক্তিকে নাকি আল্লাহ-ও পছন্দ করেন না। আর যাকে আল্লাহ পছন্দ করেনা, তাকে কি বিশ্বের মানুষরা পছন্দ করবে?



ভারতকে দোষারোপ না করে পানি সমস্যার যৌক্তিক সমাধান [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৪১ ]


বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এ বন্যার নানাবিধ কারণ থাকলেও, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও তাদের মিডিয়াগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে  সাধারণ অনেক বংলাদেশী শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করে যে, ‘‘বর্ষা মৌসুমে ভারত ফারাক্কা বঁাধ খুলে দিয়ে, তাদের দেশের অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে, যেমন শুকিয়ে মারছে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়ে পর্যাপ্ত পানি আসতে না দিয়ে’’। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ প্রকল্প। ভারত বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারে অনেক বাংলাদেশী মনে করতে শুরু করেছে যে, ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ আরেকটি ‘ফারাক্কা’ যা মূলত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নতুন ষড়যন্ত্র। আর এ বিশ্বাসের কারণে অনেক বাংলাদেশী মানুষ ভারতকে তাদের প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ দেশের পরিবর্তে ‘শত্রু’ দেশ হিসেনে মনে করে থাকে, যদিও যৌক্তিকভাবে কথাটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু। আর এ সত্যতা বিশ্লেষণে বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যায় ভারতকে কতটুকু ‘দোষী’ করা যায়, তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। দেখা যাক, ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে।

প্রথমে দেখা যাক শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি স্বল্পতা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হয়না, শীতের কারণে গঙ্গার উৎসস্থল ‘হিমালয়ে’ বরফ জমে থাকে, তাই সঙ্গত কারণেই ঐ সময়ে জল-প্রবাহ দু’অঞ্চলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে বিধায়, কোন অঞ্চলই তার চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সরবরাহ ঐ সময় পায়না। আর পানি প্রবাহের স্বল্পতার কারণে ভারত যদি ঐ সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তার চাহিদা মোতাবেক পানি ধরে না রাখে, তবে তার দেশের সেচ সুবিধা ছাড়াও কোলকাতা বন্দর বন্ধের উপক্রম হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, ঐ সময় বাংলাদেশেও পানি স্বল্পতার কারণে তাদের চাহিদামত পানি পায়না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হচ্ছে চাহিদামত ‘যোগান’ না থাকলে একটি পরিবারও কম বা পরিমিত বন্টনের নীতি গ্রহণ করে, কম ভোগের মাধ্যমে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও শুকনো মৌসুমে পানির ‘যোগান’ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় ‘কম’ থাকাতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে ‘পরিমিত’ বন্টনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে এটিই যৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তির ধারে-কাছে না গিয়ে আমাদের ভারত বিদ্বেষী ইসলামের নামধারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাংলাদেশীদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে, যদিও ইসলামে সেচ ও পানি স্বল্পতা হলে করণীয় সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফে’ সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিম্নরূপভাবেঃ

মদিনার কৃষি জমিতে জনৈক মক্কাবাসী ও মদিনাবাসীর মধ্যে পানিসেচ নিয়ে বিবাদ শুরু হলে ইসলামের নবী মহাম্মদ (সঃ) নির্দেশ দিলেন, ‘‘যার জমি উঁচুতে ও প্রথম শুরু হয়েছে, সে পর্যাপ্ত পানি নেয়ার পরই পরবর্তী জমির মালিক পানি সেচের সুবিধা পাবে’’-(সূত্রঃ বোখারী শরীফে হাদিস নং ২১৮৮ ও ২১৮৯) এই হাদিস ব্যাখ্যা করলে উচঁু তথা উজানে তথা উৎসমূলে ভারতের অবস্থান বিধায় বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ ভারতের ‘পর্যাপ্ত’ জল-চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশকে দেয়ার মত ‘পর্যাপ্ত’ পানি কি আর শুকেনো মৌসুমে অবশিষ্ট থাকে? একজন বাংলাদেশী হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের অমৌলবাদী শিিক্ষত মানুষদের উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই।

আর বর্ষার বন্যার ব্যাপারে এখন প্রায় সকল পানি বিশেষজ্ঞ একমত যে, ‘গ্রিনহাউস’ ইফেক্ট তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনামসহ সাগরপারের অনেক দেশই এখন প্রতি বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যার জন্যে যেমন ভারত দায়ী নয়, তেমনি ভারতে বন্যার জন্যে দায়ী নয় চীন কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবী হচ্ছে, ‘ভারত কেন বর্ষা মৌসুমে পানি না আটকিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারছে’? তাহলে ভারত কি বর্ষার প্রচুর বন্যার ঢল আটকে রেখে তাদের দেশকে ডুবিয়ে মারবে? এমনকি তাদের কোলকাতা বন্দর ডুবে গেলেও? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের স্থানে হলে কি তাই করতো?

এবার দেখা যাক সাম্প্রতিক ইস্যু ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রসঙ্গে। ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা ও সম্প্রতি বাংলাদেশের ঘুরে আসা ‘সংসদীয় কমিটি’ থেকে যে সকল তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়, এ উপমহাদেশের হিমালয়ের নদীগুলোতে কেবল ভারত নয়, অন্যান্য বেশ কয়েকটি ‘দেশ’ তৈরী করছে তাদের সুবিধামত ‘জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প’। ভারত ছাড়াও পাকিসত্মান মোট ৩৫টি, নেপাল ৫৪টি, ভুটান ২১টি এবং চীন তৈরী করছে অসংখ্য জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প, যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে মাত্র ১টি (কাপ্তাই)। অর্থাৎ চীন বাদে বর্ণিত দেশ ক’টি সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার দেশের সমগ্র এলাকা জুড়ে মোট ৪২৯টি জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিলেও ‘টিপাইমুখ’ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২১০ কিমি দূরত্বে ‘বরাক-টুইবাই’ নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে ভারত এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এ ক্ষেত্রে এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে ভাটিতে নয় বরং ভারতের উজানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের মত শুকনো মৌসুমে পানি আটকে সেচ বা কোলকাতা বন্দর চালু রাখার কোন প্রকল্প নয়, এটি হচ্ছে শুকনো ও বর্ষা মৌসুমে মানে সব ঋতুতে সম পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রকল্পের ‘টারবাইনগুলো’ সচল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিভাবে? বরং ভারতকে তার প্রকল্পের নিজস্ব স্বার্থেই সব ঋতুতে যেহেতু পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সে ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি প্রবাহের সুবিধা পাবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বাঁধ চালু হলে ‘টিপাইমুখের’ উজানে বরং কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির কারণে অনেক জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেমন ভারতের ‘উত্তরখন্ডে’ ১-হাজার মেঘাওয়াটের জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কারণে ‘ডেইরী’ শহরসহ ৩৭টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার নেপালের ‘কালিগন্ডকী’ প্রকল্পের কারণে হিন্দু তীর্থস্থান ‘শালগ্রাম শিলা’র একই পরিণতি হয়েছে। যেমন আমাদের ‘কাপ্তাই’ বাঁধের কারণে যেভাবে কাপ্তাই হৃদের সৃষ্টি হয়ে ক্ষতি হয়েছিল ‘চাকমা’ জনবসতি। বর্ণিত জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাটিতে কিন্তু কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় আনা উচিত ভারত যা করছে তা কি আমাদের ক্ষতির জন্যে? নাকি তার দেশের চাহিদার জন্যে? ভারতে এখন বিদ্যুৎ চাহিদা ১লাখ ৮ হাজার ৮৮৬ মেঘাওয়াট, যার মধ্যে বর্তমান ঘাটতি ১৮ হাজার ৯৩ মেঘাওয়াট। ভারত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করছে আগামী দিনগুলোতে সে জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ১,২৬,৫৮৮ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যদিও সে এখন উৎপাদন করছে মাত্র ১৯,৬৪১ মেঘাওয়াট। হ্যা, আন্তদেশীয় অভিন্ন নদীগুলোর এক তরফা পানি প্রত্যাহার হলে সংশিøষ্ট দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আমাদের ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠী তৎপর হলেও চীন সম্প্রতি তাদের ‘সাংপো’ (আমাদের ব্রম্মপুত্র) নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা করছে সে ব্যাপারে আমাদের দেশের কেউ কিন্তু আপাত কোন কথা বলছে না।

এ ব্যাপারে আমাদের উচিত বাস্তবায়তায় ফিরে আসা। ভারত যখন তার দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ‘পিয়াজ’ বা ‘চাল’ রপ্তানী বন্ধ করে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পিয়াজ/চালের দাম বেড়ে যায়, তখন আমরা ‘ভারত আমাদের পিয়াজ/চাল রপ্তানী বন্ধ করে কষ্ট দিতে চাইছে’ বলি কিন্তু বলিনা যে, আমাদের নিজেদের পিয়াজ ও চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত থেকে যেন আমদানী করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের উত্তরাঞ্চলে বড় বড় ‘জলাধার’ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধের জন্যে ‘ড্রেজিং’ করে আমাদের নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা না করে আমরা যদি কেবল ভারতকে ‘গালি’ দিতে থাকি এবং ‘হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা’ বলে ভারতকে খ্যাপাতে থাকি, তবে কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? কেবল ভারতের সঙ্গে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের পানি বন্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা মূলত ভারতেরও একটি অন্যতম সমস্যা। বুখারী শরীফের হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারত যদি আমাদের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তবে আমরা কি করবো চিন্তা করে দেখা দরকার।