মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৪০-বছরের ভারত-বাংলাদেশ বৈরিতা : সমাধান কোন পথে? [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৪৩ ]



গত বছর কোলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সিতে ভ্রমণকালে বাংলাভাষী ট্যাক্সিওয়ালার খেদোক্তি ছিল, ‘‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রায় ২০,০০০ সেনার রক্তে বাংলাদেশ রঞ্জিত হলেও এবং তখনকার অভাবী কোলকাতার মানুষের বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন, আর ১-কোটি শরণার্থীকে নানাভাবে সহযোগিতার পরও, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কেন এতো ভারত-বিদ্বেষী? কেন বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে নানা কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারী সন্ত্রাসীদের সহায়তা করে? বাংলাদেশ কি পাকিস্তান’’?

এরূপ অভিযোগ আরো শুনেছি হিন্দীভাষী চেন্নাইগামী ট্রেনযাত্রীর মুখে ‘করোমন্ডল এক্সপ্রেসে’। যদিও কোলকাতার অধিকাংশ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির ব্যাপারে খুবই ‘নস্টালজিক’ এবং পশ্চিম বঙ্গের মতই তারা মনেপ্রাণে রাজনৈতিক বাংলাদেশকে ভালবাসে, বিশেষ করে এক সময় যাদের পূর্বপুরুষরা বাস করতো পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে। সুসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত মানুষেরাও তিস্তার পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে সহাস্যে যখন ’বাংলাদেশকে সব দিয়ে দিতে বলেন’ তখন এদেশের জন্যে তাদের হৃদ-উৎসারিত অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশিত হতে দেখে বাঙলাদেশি হিসেবে আমি আপ্লুত হই। কোলকাতার ট্যাক্সিওয়ালা কিংবা হিন্দীভাষী ট্রেনযাত্রীর প্রশ্ন আমাকে দারুণভাকে ভাবিয়ে তোলে। হ্যা, যে দেশটি ন’মাস ভূমিধ্বস সহযোগিতা করে, পাকিস্তান তথা আমেরিকা প্লাস চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে একটি দেশের স্বাধীনতার ফুল ফোটাতে সাহায্য করেছিল, ঘরে বাইরে করেছিল নানাবিধ সহযোগিতা, তার ব্যাপারে কেন এদেশের কোটি কোটি মানুষের নেতিবাচক ধারণা? বিষয়টির একটু গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে।

চলমান সমূয়ে ভারত নানাভাবে সন্ত্রাসী আক্রান্ত আর আতংকিত একটি দেশ। একদিকে জন্ম থেকেই চিরশত্রু পাকিস্তান অপর দিকে চীন, পূর্ব সীমান্তের সামরিক শাসনাধীন ‘মায়ানমার’ আবার চীনের ধামাধরা। প্রায়ই দেশটিতে নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটে থাকে, যার কয়েকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ নিম্নরূপঃ

১৮/৬/২০০০ তারিখ ভারতের কেল্লার মোড়ে জোড়া বিস্ফোরণ, ১৩/১২/২০০১ ভারতের সংসদে ৫ জঙ্গী ঢুকে হত্যা করে ১২ জনকে, ২৫/১০/২০০৫ ভারতের ৩ শহরে বিস্ফোরণ নিহত ৫৯, ১৩/৯/২০০৮ কনট প্লেস, করোলবাগ ও গ্রেটার কৈলাস বিস্ফোরণ ও নিহত ২৫, ২৭/৯/২০০৮ কুতুব মিনারের কাছে ফুলবাজারে বিস্ফোরণে নিহত ৩, তাজমহল হোটেলে প্রকাশ্যে ফায়ার ফাইট ও বিষ্ফোরণে হুজির সমর্থনদাতা হিসেবে পাকিস্তানের আইএসআই ছাড়াও বিগত সরকারগুলোর সময় বাংলাদেশের ডিজিএফআই-এর দিকেও অভিযোগ তুলতো ভারত। যদিও ভারত এখনো বের করতে পারেনি, বার বার কাদের অর্থে ও নেতৃত্বে ভারতে বড় আকারের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক দিল্লি হাইকোর্টে আক্রমনে হুজি বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আবিস্কৃত হয়েছে ‘এনআইএ’-সহ ভারতীয় নানা মাধ্যমে।

ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। অনেক সমালোচক ও বুদ্ধিজীবীই এখন বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে ভারতের অনেক চ্যানেল দেখানো হলেও, ভারতে বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো দেখানো হয়না। কথাটি কতটুকু সত্য আলোচনা করা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক ভারত কিংবা বাংলাদেশে বিশ্বের ২-৪টি নিষিদ্ধ (পর্ন বা এই শ্রেণির) চ্যানেল ছাড়া পৃথিবীর সব চ্যানেলই উন্মুক্ত। বাংলাদেশের ক্যাবল ব্যবসায়ীরা এদেশের জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে স্টার-প্লাস, সনি, জি-বাংলা ইত্যাদি চ্যানেল প্রর্দশন করছে। এটি ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কোন উদ্যোগ নয়। বর্ণিত ভারতীয় চ্যানেল না দেখানো হলে, আমাদের অনেক মধ্যবিত্তই হয়তো ‘ক্যাবল কানেকশন’ রাখবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী মায়ানমার বা ভুটানের কোন চ্যানেল বাংলাদেশের মানুষেরা দেখতে চাচ্ছেনা বলে এদেশের ক্যাবল অপারেটরা তা দেখাচ্ছে না। এর মানে বার্মার চ্যানেল কি এদেশে নিষিদ্ধ? আমরা কোলকাতাতে মার্কুইজ স্টিটের হোটেলগুলোতে বাংলাদেশী চ্যানেল দেখেছি। সম্ভব না হলে তারা দেখায় কিভাব? যেহেতু সেখানের হোটেলগুলোতে বাংলাদেশীরা থাকে বিধায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ ‘এটিএন বাংলা’সহ বাংলাদেশী কয়েকটি চ্যানেল চালাচ্ছেন। বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোতে অধিকাংশই এদেশের খবর ও রাজনৈতিক টক-শো থাকে বিধায়, ভারতীয়রা তা দেখতে খুব আগ্রহী নয়, যেমন বাংলাদেশী দর্শকরাও ভারতীয় খবর ও টকশো খুব একটা পছন্দ করেনা, যেমনটি করে বর্ণিত চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয় সিরিয়াল, হাসির অনুষ্ঠান, মীরাক্কেল, তারা মিউজিক, কোনবনেগাক্রোরপতি, আপকা কাচারীর মত মান সম্মত অনুষ্ঠান। আমাদের চ্যানেলগুলো ঐ মানের অনুষ্ঠান তৈরী করলে, অবশ্যই ভারতীয়রা তাদের নিজের গরজে দেখবে আমাদের চ্যানেল। এদেশের অপারেটররা এখন ‘পিটিভি’ কিংবা ‘সৌদি টিভি’ দেখালেও ক’জন দর্শক তা দেখে?

আরেকটি অভিযোগ করা হয়ে থাকে ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃৃক ভিসা প্রদানে হয়রাণি ও কড়াকড়ি, কথাটি সত্য। আসলে বর্তমান জালিয়াত ও সন্ত্রাসী বিশ্বে কড়াকড়ি ছাড়া কেউই বাংলাদেশীদের ভিসা দিতে চায়না। যারা ইউরোপ-আমেরিকার ভিসা চেয়েছেন তারা জানেন ‘ভিসাপ্রাপ্তি কাকে বলে’? আমি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বৃটেন ভ্রমণ করে দেখেছি ভিসা জটিলতা কত। আসলে সব দেশই বাংলাদেশীদের ব্যাপারে কড়াকড়ি করলেও, বদনামটি কেবল ভারতের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় দূতাবাসের বক্তব্য হচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় ২০০০ বাংলাদেশীকে ভারতীয় ভিসা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যা পৃথিবীর সকল ভারতীয় দূতাবাসগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে সীমান্তে মানুষ বা বাংলাদেশী হত্যা। হ্যা ফেলানীর মত কিশোরীর মৃত্যু আমাদের সকলকে কাঁদায়। এটি সম্ভবত ভারত করে থাকে তার নিজের দেশের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধের জন্যে। যেহেতু জেএমবি-হুজিরা এখনো গভীর রাতেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়। আমাদের মত অসন্ত্রাসী মানুষরা কখনো গভীর রাতে সীমান্তে যাবে কি? ভারতীয় সীমান্তে রাতে ‘কারফিউ’ থাকা সত্বেও কারা সীমান্তে যায়? এটি নিন্দনীয় হলেও, ভারত যতদিন তার সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে চায়, ততদিন আমাদেরও রাতে তাদের সীমান্ত অবৈধ পাড়ি দেয়া বন্ধ করলে, তারা কি আমাদের ঘরে এসে আমাদের হত্যা করবে? একটি জরীপে দেখা গেছে, ভারতীয় সীমান্তে গড়ে বছরে ১০০ বাংলাদেশী হত্যা করা হয়। কিন্তু আমরা নিজেরা সড়ক দুর্ঘটনার নামে প্রত্যহ গড়ে ৫০ জন বাংলাদেশী মানুষ হত্যা করছি তা কি জানি?

সরব গলায় আরেকটি কথা বলা হয়ে থাকে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির কথা। আসলে ভারতের চেয়ে অনেক বেশী বাণিজ্য ঘাটতি আমাদের চীনের সঙ্গে যা প্রায় ৯২%। চীন বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানীতে প্রথম, তারপরও চীনা কোম্পানীগুলো আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিকম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারী কাজ পায় ঠিকই। এমনকি চীন ব্রহ্মপুত্র নদীকে ব্যাপক বাঁধ দিয়ে যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বানাচ্ছে তা কি বাংলাদেশে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে? না সে কথা আমরা খুব একটা বলছি না যতটা বলছি ভারতের ব্যাপারে।

আসলে বাংলাদেশ হচ্ছে একটি আমদানী নির্ভর দেশ। আমাদের ভোগ্যপণ্যের খুব কমই আমরা উৎপাদন করতে পারি, অধিকাংশ জিনিসই আমাদের আমদানী করতে হয়। আমাদের গাড়ি অধিকাংশ আনা হয় জাপান থেকে। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স মালপত্র অধিকাংশ চীন থেকে। পেয়াজ, রসুন, আদা, জিরা ইত্যাদি হাজারো নিত্য ভোগ্যপণ্য কেনা হয় ভারত থেকে। কিন্তু আমাদের রপ্তানী পণ্য খুব কম। যারা যে পণ্য উৎপাদন করে তারা সাধারণত ঐ পণ্যটি তার দেশে প্রবেশ করতে দেয়না। বাংলাদেশ ‘গার্মেন্টস’ বা ‘ইলিশ মাছ’ উৎপাদন করে বিধায় ঐ দুটো পণ্য কি বাংলাদেশে আমদানী করার অবাধ স্বাধীনতা কাউকে দেবে? যেমন দেবে না জাপান তার দেশে কাউকে গাড়ি আমদানী করতে। চীন দেবেনা তার দেশে উৎপাদিত হয় এমন পণ্য কোন চীনা কোম্পানীকে আমদানী করতে। ভারত এখন প্রায় সকল ভোগ্য পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। তারা বলতে গেলে নিজেরাই এখন প্রায় সব পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানী করে। এখন কোন যুক্তিতে তারা তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশ থেকে শুল্কমুক্তভাবে ভেতরে ঢুকতে দেবে? কিন্তু এমন কোন পণ্য কি আছে যা কেবল বাংলাদেশ উৎপাদন করে কিন্তু ভারত করতে পারেনা? হ্যা, ভারত যাত্রীবাহী বিমান আমদানী করে কিন্তু বাংলাদেশ কি তা ভারতের কাছে রপ্তানী করার ক্ষমতা রাখে? কাজেই আজকের বিশ্বের বাস্তবতার যুক্তিতে বাংলাদেশ ভারত বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি আপেক্ষিক। এটি কমবে যেদিন বাংলাদেশে নিজেরা তার নিত্যপণ্য উৎপাদন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, আর পেয়াজ রসুন, হলুদ মরিচ ভারত থেকে আমদানী করতে হবে না।

আসলে পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুতে হত্যার পর এদেশের বিভিন্ন শাসকরা নানাভাবে প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার, ভারত বিদ্বেষী সন্ত্রাসীদের লালন ও মদদ প্রদান করেছে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে। ৩০ বছরের অপশাসনে এন্টি-ভারত ও এন্টি-আওয়ামী লীগ প্রচারণা চলছিল অব্যাহত ধারায়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হালমার জন্য ভারতকে সরাসরি দায়ী করেছিলেন আমাদের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব। পুরুলিয়ার অস্ত্র ফেলার রেশ না কাটতেই, আবার ১০ ট্রাক অস্ত্র আনা হলো ভারতের বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমান্ত বিরোধ ও হত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, পানির বঞ্চনা, বাণিজ্য ঘাটতি, বর্ষায় পানি ঠেলে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ।

এদেশের বন্যার নানাবিধ কারণ থাকলেও, ভারত বিরোধী পক্ষ ও তাদের মিডিয়াগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে সাধারণ অনেক বংলাদেশী শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করে যে, ‘‘বর্ষা মৌসুমে ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে, তাদের দেশের অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে, যেমন শুকিয়ে মারছে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়ে পর্যাপ্ত পানি আসতে না দিয়ে’’। এর সঙ্গে তারা যুক্ত করছে ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রকল্প। ভারত বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারে অনেক বাংলাদেশী মনে করে যে, ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ আরেকটি ‘ফারাক্কা’ যা মূলত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নতুন ষড়যন্ত্র। আর এ বিশ্বাসের কারণে অনেক বাংলাদেশী মানুষ ভারতকে তাদের প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ দেশের পরিবর্তে ‘শত্রু’ দেশ হিসেনে মনে করে থাকে, যদিও যৌক্তিকভাবে কথাটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু।

সাম্প্রতিক শেখ হাসিনা-মনমোহন চুক্তিতে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, সীমান্ত প্রটোকল, ৪৬-পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ, ৩-বিঘা ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা, বাংলাদেশী পণ্য নেপাল- ভুটানে যাওয়ার ট্রানজিট, ছিটমহল সমস্যার চুক্তি হয়েছে। ভারতীয় ৮৫/২০১১ নং প্রজ্ঞাপনে ৪৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত হওয়াতে বাংলাদেশ যেমন উৎফুল্ল হয়েছে, তেমনি গোস্বা হয়েছে মুম্বাই ও দিল্লির গার্মেন্টস শিল্প মালিকগণ, যার মধ্যে ২৪টি নিটওয়ার, ২১টি ওভেন ও ১টি সিল্ক ফেব্রিক্স, যা সবই ভারত নিজেরা উৎপাদন করে। ভারতের পোশাক শিল্প মালিকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় মনমোহন সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে (এ জন্যই কি নির্বাচনে এমন ফলাফল?)।

ভারত তার ১১১ ছিটমহল বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বিনিময়ে কোনরূপ পূর্বশর্ত বা ক্ষতিপুরণ ছাড়াই প্রায় ৭০০০ একর অতিরিক্ত জমিসহ বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। তা ছাড়া বিতর্কিত ৪ কিমি এলাকা (ত্রিপুরার মুহুরী নদী এলাকা, পশ্চিমবঙ্গের দাইকাটা, করিমগঞ্জের লাঠিটিলা-ডুমাবাড়ি) ভারত দাবী করেনি। বিগত যৌথ জরীপ ও অপদখীয় ভূমি হস্তান্তরের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ পাবে ২৬৭ একর, আর ভারত পাচ্ছে ২৬১ একর। যদিও এখনো আসামের ৪৮৫ একর ভূমি অমিমাংসিত রয়েছে। আসামের ৬০০ একর বাংলাদেশ পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ জমি নিয়ে ২০০১ সনে বিডিআর-বিএসএফ সীমান্ত সংঘর্ষে ১৬-জন বিএসএফ প্রাণ হারায়। করিমগঞ্জের ৩৬৪ একর জমি বাংলাদেশকে দেয়াতে, ইতোমধ্যেই আসামের বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কংগ্রেস ও মুখ্য মন্ত্রী গগৈর বিরুদ্ধে নানাবিধ কর্মকান্ড শুরু করেছে। আসামের ধুবড়ী জেলার বড়াইবাড়ি সীমান্তের বিতর্কিত ১৯৩ একর জমি পেয়েছে বাংলাদেশ। যা নিয়ে আসামে এখন আন্দোলন তুঙ্গে। আসামীরা একে বিশ্বাসঘাতকতার চুক্তি বলছেন।


আমরা এ অঞ্চলে ৪০-বছরে সার্কের ভূমিকা দেখেছি প্রায় শূন্য। যেখানে আশিয়ানদের মধ্যে সড়ক, ট্রেন, সব উন্মুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জিসিসির মত ভারত-বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও ২-দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরী, যাতে চুক্তি বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করে এবং ১৯৭২-৭৪ সনে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন সহজ হয়। অনেকেই মমতাকে ‘ড্রামা কুইন’ বলেন। তিনি তিস্তার পানি মাপার কথা বলছেন, মমতার শিক্ষা ‘‘দেশের স্বার্থ সবার আগে’’। ভারতের থেকে দেশপ্রেম শিক্ষণীয় আমাদের কারণ আমাদেরই পত্রিকারই খবর, রেলের ৫০-হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়েছে আমাদের ভূমিদস্যুদের হাতে।

অনেকেই বলেন, ট্রানজিট আমাদের ‘ট্রাম-কার্ড’ কিন্তু তিস্তা বা অন্য ৫৩টি নদীর পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যা। ভারতের কাছে না চেয়ে বরং আমাদের ‘ন্যায্য হিস্যা’ আদায়ের জন্যে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে। কিন্তু আমার জানা নেই, এমন কোন ‘আন্তর্জাতিক ফোরাম’ বাংলাদেশের পক্ষে আছে কিনা, যারা ২-দেশের অভিন্ন নদীর পানি এককভাবে ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের জন্যে বরাদ্দ করবে। আসলে এমন কোন ফোরাম নেই, এগুলো শুধু কথার ফানুস, যা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসলে বুঝতে হবে, তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিম তথা ১টি হ্রদে। বাংলাদেশের মত তিস্তার পানি আসলে নদী অববাহিকার সকল মানুষের ন্যায্য হিস্যা। একইভাবে ভারতীয়দের কাছে গঙ্গা পবিত্র। গঙ্গার পানি উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কৃষকরা ব্যবহারের পর ভাটিতে দেয়ার মত পানি থাকে খুব কম বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। এ ক্ষেত্রে ‘সাপস্নাই’ কম কিন্তু ‘ডিমান্ড’ বেশী বলে ‘রেশনিং’ তথা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যে বের করতে হবে কল্যাণকর কোন পথ, যার কথা বলছেন মনমোহন ও হাসিনা সরকার। এক্ষেত্রে আমাদের কথাবার্তায় ভারত বৈরিতা পরিহারের মাধ্যমে আমরা সীমান্তে বিরোধ, ফারাক্কা পানির বঞ্চনা, বাণিজ্য ঘাটতি, বর্ষায় বন্যা ইত্যাদি সমাধানে এগিয়ে আসতে পারি। যেমনটি সম্প্রতি করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে মাল পরিবহনে সহযোগিতার জন্যে ‘বাংলাদেশের কাছে ঋণী’ বলে তথা ‘ঋণ স্বীকার করে’।

এবার দেখা যেতে পারে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি স্বল্পতা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হয়না, শীতের কারণে গঙ্গার উৎসস্থল ‘হিমালয়ে’ বরফ জমে থাকে, তাই সঙ্গত কারণেই ঐ সময়ে জল-প্রবাহ দু’অঞ্চলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে বিধায়, কোন অঞ্চলই তার চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সরবরাহ ঐ সময় পায়না। আর পানি প্রবাহের স্বল্পতার কারণে ভারত যদি ঐ সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তার চাহিদা মোতাবেক পানি ধরে না রাখে, তবে তার দেশের সেচ সুবিধা ছাড়াও কোলকাতা বন্দর বন্ধের উপক্রম হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, ঐ সময় বাংলাদেশেও পানি স্বল্পতার কারণে তাদের চাহিদামত পানি পায়না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হচ্ছে চাহিদামত ‘যোগান’ না থাকলে একটি পরিবারও কম বা পরিমিত বন্টণ তথা ‘রেশন-নীতি’ গ্রহণ করে, কম ভোগের মাধ্যমে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও শুকনো মৌসুমে পানির ‘যোগান’ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় ‘কম’ থাকাতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে ‘পরিমিত’ বন্টনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে এটিই যৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তির ধারে-কাছে না গিয়ে আমাদের ভারত বিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাংলাদেশীদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে, যদিও ইসলামে সেচ ও পানি স্বল্পতা হলে করণীয় সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফে’ সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিম্নরূপভাবেঃ


মদিনার কৃষি জমিতে জনৈক মক্কাবাসী ও মদিনাবাসীর মধ্যে পানিসেচ নিয়ে বিবাদ শুরু হলে ইসলামের নবী মহাম্মদ (সঃ) নির্দেশ দিলেন, ‘‘যার জমি উঁচুতে ও প্রথম শুরু হয়েছে, সে পর্যাপ্ত পানি নেয়ার পরই পরবর্তী জমির মালিক পানি সেচের সুবিধা পাবে’’-(সূত্রঃ বোখারী শরীফে হাদিস নং ২১৮৮ ও ২১৮৯) এই হাদিস ব্যাখ্যা করলে উচুঁ তথা উজানে তথা উৎসমূলে ভারতের অবস্থান বিধায় বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ ভারতের ‘পর্যাপ্ত’ জল-চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশকে দেয়ার মত ‘পর্যাপ্ত’ পানি কি আর শুকেনো মৌসুমে অবশিষ্ট থাকে? একজন বাংলাদেশী হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী শিক্ষেত মানুষদের উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই।

আর বর্ষার বন্যার ব্যাপারে এখন প্রায় সকল পানি বিশেষজ্ঞ একমত যে, ‘গ্রিনহাউস’ ইফেক্ট তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনামসহ সাগরপারের অনেক দেশই এখন প্রতি বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যার জন্যে যেমন ভারত দায়ী নয়, তেমনি ভারতে বন্যার জন্যে দায়ী নয় চীন কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠীর দাবী হচ্ছে, ‘ভারত কেন বর্ষা মৌসুমে পানি না আটকিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারছে’? তাহলে ভারত কি বর্ষার প্রচুর বন্যার ঢল আটকে রেখে তাদের দেশকে ডুবিয়ে মারবে? এমনকি তাদের কোলকাতা বন্দর ডুবে গেলেও? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের স্থানে হলে কি তাই করতো?

দেখা যাক সাম্প্রতিক ইস্যু ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রসঙ্গে। এ উপমহাদেশের হিমালয়ের নদীগুলোতে কেবল ভারত নয়, অন্যান্য বেশ কয়েকটি ‘দেশ’ তৈরী করছে তাদের সুবিধামত ‘জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প’। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান মোট ৩৫টি, নেপাল ৫৪টি, ভুটান ২১টি এবং চীন তৈরী করছে অসংখ্য জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প, যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে মাত্র ১টি (কাপ্তাই)। অর্থাৎ চীন বাদে বর্ণিত দেশ ক’টি সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মানে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার দেশের সমগ্র এলাকা জুড়ে মোট ৪২৯টি জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মধ্যে ‘টিপাইমুখ’ একটি। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২১০ কি.মি দূরত্বে ‘বরাক-টুইবাই’ নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে ভারত এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মানের পরিকল্পনা করছে। এ ক্ষেত্রে এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে ভাটিতে নয় বরং ভারতের উজানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের মত শুকনো মৌসুমে পানি আটকে সেচ বা কোলকাতা বন্দর চালু রাখার কোন প্রকল্প নয়, এটি হচ্ছে শুকনো ও বর্ষা মৌসুমে মানে সব ঋতুতে সম পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রকল্পের ‘টারবাইনগুলো’ সচল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিভাবে? বরং ভারতকে তার প্রকল্পের নিজস্ব স্বার্থেই সব ঋতুতে যেহেতু পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সে ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি প্রবাহের সুবিধা পাবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বাঁধ চালু হলে ‘টিপাইমুখের’ উজানে বরং কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির কারণে অনেক জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন প্রজেক্ট করবেন না।

এ ব্যাপারে আমাদের উচিত বাস্তবায়তায় ফিরে আসা। ভারত যখন তার দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ‘পিয়াজ’ বা ‘চাল’ রপ্তানী বন্ধ করে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পিয়াজ/চালের দাম বেড়ে যায়, তখন আমরা ‘ভারত আমাদের পিয়াজ/চাল রপ্তানী বন্ধ করে কষ্ট দিতে চাইছে’ বলি কিন্তু বলিনা যে, আমাদের নিজেদের পিয়াজ ও চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত থেকে যেন আমদানী করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের উত্তরাঞ্চলে বড় বড় ‘জলাধার’ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধের জন্যে ‘ড্রেজিং’ করে আমাদের নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা না করে আমরা যদি কেবল ভারতকে ‘গালি’ দিতে থাকি এবং ‘হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা’ বলে ভারতকে খ্যাপাতে থাকি, তবে কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? কেবল ভারতের সঙ্গে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের পানি বন্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা মূলত ভারতেরও একটি অন্যতম সমস্যা।

আসলে কাউকে ঠকানোর মনোবৃত্তি নিয়ে নিজ লক্ষে কখনো পৌঁছা যায় না। আমাদের উচিত হবে, ভারত থেকে প্রবাহিত ৫৪ নদীর পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্টনের আন্দোলন জোরদার করা, যাতে বাংলাদেশ-ভারত নির্বিশেষে নদী অববাহিকার সকল নদীনির্ভর মানুষগুলো তাদের জল-কেন্দ্রীক জীবনধারা সচল রাখতে পারে তার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। কাউকে বঞ্চিত করে, ঠকিয়ে কিংবা হটকারী কথাবার্তা না বলে সবার উপরে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা, যাতে গাঙ্গেয় অববাহিকার প্রাকৃতিক দুর্যোগনির্ভর এ জনগোষ্ঠীর মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটে ওঠে। নতুন মোদি সরকার কি চাইবেন প্রাক্তন কংগ্রেস সরকারের মতই তারা আন্তরিক বাংলাদেশ-ভারত সমস্যা সমাধানে। এ প্রত্যাশা থাকবে প্রত্যেকটি বাঙলাদেশির নতুন মোদি সরকারের প্রতি!



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন