সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারত গমন : স্বরূপ সন্ধান : যৌক্তিকতা আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে Part - ৭ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ১৩ ]


বাংলাদেশ থেকে ভারতে গমনকারী পরবাসী 'মিহির সেন গুপ্ত'র হৃদ হননের ক্লেদাক্ত গান !
:
মেট্রিক পাশ করে, এক বছর কলেজে পড়াশোনার চেষ্টা চালিয়েও যে নানা কারণে সুবিধা করতে পারিনি তার জন্য আমার নিজের নির্বুদ্ধিতা, অভিভাবকদের উদাসীনতা। তাই সিদ্ধান্ত হিন্দুস্থানে গিয়ে যদি কিছু ভাগ্য পরিবর্তন হয়। কারণ আগেই বলেছি ঘরে বাইরে শেখানো সেই বুলি, হিন্দুস্থান হিন্দুর এবং পাকিস্তান মুসলমানদের। সুতরাং হিন্দুস্থানে গিয়ে রাজা হবার খোয়াব। মানসিকতার দিক থেকে তখনকার তথাকথিত ভদ্র হিন্দু সন্তানেরা সত্যই সেরকমই খোয়াব দেখতাম, যেটা সামপ্রদায়িক শিক্ষার ফল। 
:
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনেছি এবং শিখেছি পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য, হিন্দুস্থান হিন্দুদের জন্য। এদেশে যারা হিন্দু আছে, তাদের সবাইকে একদিন অবশ্যই হিন্দুস্থানে চলে যেতে হবে। তাহলে কী তারা সবাইই উদ্বাস্তু হয়ে যাবে? পরে জেনেছি, ব্যাপারটা সেরকম নয়। যারাই ওদেশে যাচ্ছে, তাদের সবাই উদ্বাস্তু নয়। যাদের ওখানে কোনো রকমই সহায়-সম্বল নেই, বাড়ি বা বাসা নেই, ক্যাম্পে, শেয়ালদা স্টেশান নামে একটা রেল স্টেশানের চত্বরে পড়ে থাকে, তারাই শুধু উদ্বাস্তু। হিন্দুস্থানের সরকার তাদের জন্য সব সুখ-সুবিধের বন্দোবস্ত করে। সেখানের গভর্নমেন্ট হিন্দু কী না তাই! আমাদের সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঐ সময় এ রকম কথা খুব চলতো।
:
বরিশাল শহরে কলেজে পড়ার সময়, স্টিমার ঘাটের আশেপাশে কিছু ভিনদেশী মানুষ দেখেছি। সেখানে তাদের ‘মোহাজের’ বলতো সবাই। আমরা জানতাম তারা বিহারী মুসলমান। পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ বলে এখানে থাকতে এসেছে হিন্দুস্থান ছেড়ে। অনেক পরে জেনেছি যে তারাও দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচার জন্য এদেশে এসেছে, যেমন এদেশের হিন্দুরা হিন্দুস্থান যাচ্ছে। তখন আমার বয়বয়স ষোল সতেরো, কিন্তু তখনো হিন্দুস্থান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চরিত্রগত ব্যাপার-স্যাপারগুলো ঠিকমতো বুঝতাম না। 
:
আমাদের অঞ্চলে দাঙ্গার কোনো অভিজ্ঞতা হয় নি। আতঙ্ক এবং গুজব অবশ্য বরাবরই ছিল। এসব কথা বিষাদবৃক্ষে সবিস্তারে লিখেছি, পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। তবে প্রধান কথা যেটা সেটা হলো, আমার এই দেশত্যাগের পিছনে দাঙ্গার কোনো ভূমিকা নেই। আমাকে অন্তত কেউ মেরে তাড়ায়নি। আমার এই দেশছাড়ার ব্যাপারটা হঠাৎই ঠিক হয়েছিল। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর যে আতঙ্ক এদেশে হিন্দুদের মধ্যে সর্বগ্রাসী প্রভাব ফেলেছিল সেই আতঙ্কেই আমার দাদা দিদিদের পশ্চিমবঙ্গে, কোলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। 
:
নানা কার্যকারণ পরম্পরায় এটা বুঝেছিলাম আমার বা আমাদের মতো ছেলেদের এই দেশে কিছু হওয়ার নেই। এমনকী রাষ্ট্র যদি কিছু সুযোগ দেয়, তাও নয়। কারণ বাল্যাবধি নিজ সমাজ এবং পরিবারের যে কুশিক্ষায় বড়ো হয়েছি, তাতে ওই সময়, এই দেশটিকে, আমরা আর নিজেদের সত্যিকারের দেশ বলে ভাবতে পারছিলাম না, চাইছিলামও না বোধহয়। এর জন্য সংখ্যাগুরু সমাজের সামপ্রদায়িকতাবাদিরা এবং রাষ্ট্র যেমন দায়ী, দায়ী আমার হিন্দুসমাজের সামপ্রদায়িকতাবাদীরাও। তারা কেউই সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে নি। 
:
ফলে, আমাদের প্রজন্মের হিন্দু সন্তানদের মানসিকতা দোদুল্যমানতার মধ্যেই ছিল, দেশ ছাড়ব, না থাকবো-আমাকে বাস্তবে যে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করতে হয়েছে সেগুলোই সাতকাহন বলছি বটে, কিন্তু পরিস্থিতির গভীরে যে আরো সত্য আছে, তার উদ্ঘাটন খুব সহজ নয়, আর সহজ নয় বলেই এ ব্যাপারে নিয়ত নিজেকে নানাভাবে খুঁড়তে হয়। আমার বিষাদবৃক্ষ সেই খোঁড়াখুঁড়ির ফল, এ রকম বলা আমার পক্ষে বোধহয় খুব আত্মশ্লাঘার হবে না। খোঁড়াখুঁড়িটা ঠিকমতো না হলে, আমরা বড়ো বাজে কথা বলি। সেইসব বাজে কথা বলার মতো মানুষ উপমহাদেশে নেহাৎ কম নেই। তারা কেউই নিজেকে খোঁড়েন না, কথাটা উপমহাদেশে আজও সত্য। 
:
কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর বুঝতে পারছিলাম, চিরদিনের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাবার মানসিকতাটা কখন যেন অন্তর্হিত হয়েছে। যদিও গ্রামগুলো ততদিনে শূন্যপ্রায়, ভাললাগার মতো, মনে আনন্দ সৃষ্টি করার মতো কিছুই আর এখানে অবশিষ্ট নেই। তথাপি মাঠ, মাটি, ঘাস, গাছপালা, অবশিষ্ট হতভাগ্য এবং কালের বলি হিন্দু পরিবারগুলো, যে ভূমিহীন মুসলমান চাষী পরিবারের মানুষজন দেশভাগের কোনো প্রসাদ পায়নি আজাদির নামে তারা, কী ভীষণভাবেই না সবাই আমার সঙ্গে ওতপ্রোত। তারা কেউই ছাড়তে চাইছে না আমাকে। ভালয় মন্দে এরাই তো আমার স্বদেশ, এরাই স্বজন। 
:
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমার মা, ভাইবোনদের সঙ্গে আমার এইসব সঙ্গীসাথীরাও আমাকে নিরস্ত করতে চাইছিল। কিন্তু হায়, তা যে আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাদের মতো মানুষদের যে আমি কোনোদিন ভুলে যাইনি, তার প্রমাণ এতদিন পরেও তারা আমার লেখার উপজীব্য হয়েছে। 
:
গ্রাম ছাড়ার শেষ মুহূর্তটার কথা আজও মনে পড়ে। খালের দুই পারের নিবাসী ভূমিহীন দরিদ্র চাষী ঘরের বন্ধুরা সবাই যেন তাদের স্বজন বিচ্ছেদের ব্যথায় শোকাকুল। এরা সবাই দরিদ্র। দরিদ্র আমার অনুজ-অনুজারাও। আশ্চর্য! আমার ঐ সব সঙ্গীসাথীরা, যাদের আশ্রয়ে আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলো, এই শূন্য অঞ্চলেও মুখর হতে পেরেছিল, যারা আক্ষরিক অর্থেই আমার ও আমার এইসব অনুজ-অনুজাদের ক্ষুধায় নানান বনজ আহার্য যুগিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে, তারা ওদের সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে আমার অনুপস্থিতিতে তারাই ওদের দেখবে। হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে নিম্নবর্গীয় এইসব মানুষেরা, যখন আমরা মধ্যস্বত্বভোগী বা তালুক-মুলুকের অধিকারী ছিলাম, আমাদের কাছ থেকে কিছু সহায় সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু সেসব ছিল তাদের শ্রমের বিনিময়ে। কিন্তু এই সময়টায় তারা যে সহায়তা আমাদের করেছে, তার কোনো বিনিময় মূল্য ছিল না। 
:
শেষ বিদায় নিয়ে মায়ের আলিঙ্গনচ্যুত আমি, হিন্দুসংস্কারবশত, আশপাশ সমগ্র বস্তু, অবস্তু, প্রাণী, অপ্রাণীকে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বলেছিলাম, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর। হে গৃহ, হে পার্শ্বস্থ বৃক্ষ, হে লতাগুল্মের ঝোপ, হে দিগন্তব্যাপী ঘাস এবং তৃণশম্প, হে আমার দুর্দিনের আর নিঃসঙ্গ দিনগুলোর সাথী রাখাল, কিষাণবৃন্দ, তোমরা পলায়নপর এই অক্ষম জাতককে করুণা কর, ক্ষমা কর। আমি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে আমার অনুজ-অনুজাদের বাঁচাবার জন্য দেশ ত্যাগ করছি। আমি তোমাদের সবার কাছে আবার ফিরে আসবো।
:
কিন্তু তথাপি যেন পরিপার্শ্বস্থ আমার স্বজনেরা, ঠাকুরদা ঠাকুরমার মাটির চিতা দু’টি, ঠাকুরদা মশাইয়ের আশ্রম বাড়ি, বাগান, যেন বলছিল, তিষ্ঠ ক্ষণমিহ। কোথায় যাবে? কিসের আশায়? যেখানে যাবে, সেখানে সুস্থিতি আছে? শান্তি, স্বস্তি আছে আরও ঢের? অনিশ্চয়তা, অসম্মান, গ্লানি সেখানেও নেই নাকী? না, এর কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারে নি। আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। পারিবারিক রীতি মেনে, কোনো পুরোহিত উচ্চারণ করে নি সেই পরিচিত মন্ত্রগীতি, ধেনুর্বৎস্য প্রযুক্তা, পুষ্পমালা পতাকা, দ্বিজ নৃপ গণিকা, সদ্যোমাংস ঘৃতংবা দক্ষিণাবর্ত্মবহ্নিঃ... ইত্যাদি। না এ রকম আয়োজনের দিন তো সেই কবেই শেষ, আমার সম্বল হলো শুধু সবার চোখের জল। 
:
পাকিস্তান আমলে যতদিন এদেশে ছিলাম, স্কুল কলেজে জাতীয়তার একরকম পাঠ পেয়েছি। যখন হিন্দুস্থানে গিয়েছি তখন পেয়েছি অন্যরকম। কোনোটাই মজ্জা মগজে যে তেমন ঢুকেছে এমন নয়। সর্বত্রই আমার ধারণা হতো, আমি যখন এ দেশের নাগরিক, তখন ঐ দেশের সবাই আমার শত্রু। সে অর্থে, পরবর্তী জীবনে আমি যাকে বাংলাদেশ মুক্ত হবার সদ্য সদ্য পরে বিয়ে করি, পাকিস্তানী নাগরিক থাকা অবস্থায় তিনি আমার এবং হিন্দুস্থানী নাগরিক হিসেবে আমি তাঁর শত্রু। 
:
আমাদের ‘বোধের দেশ’ একটাই, তাকে ১৯৪৭-এর করাতটা দু’ভাগ করতে পারে নি। কিন্তু টেনে, হিঁচড়ে শিকড়টা ছিঁড়তে পেরেছে খানিক। ওখানেই আমাদের হার হয়েছে। ঐ ছেঁড়া অংশের শিকড়টুকুর জন্যই আমাদের দেশ দেশ করা। নইলে যেখানে পারি সেখানে থাকি, তাতে আর কী এসে যায়? বাঙালি তো জন্মসূত্রেই উদ্বাস্তু, সমপ্রদায় নির্বিশেষেই। 
:
সীমান্ত পারাপার করার সময় নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, সেটা যেন একটা মস্ত হা-মুখ ফাটল, যেখানে আমার দেশ নামক বোধটা চিরদিনের মতো তলিয়ে গেছে দুপাশে দুটো নির্বোধ, হৃদয়হীন, চৈতন্যহীন রাষ্ট্রকে রেখে যারা মানুষকে বাদ দিয়ে শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতার কথা ভাবে। তার কোনোটিতেই দেশজাতক আমার কোনো অস্তিত্ব বা অস্মিতার চিহ্নমাত্র নেই-দেশের মানুষ বলে। কেউ যেন আর কোনোদিন জানতে চাইবে না, তোমার দেশ কোথায়? ভদ্রাসন কোথায় ছিল তোমার? 
:
পরিজায়ী মিহির সেন গুপ্তের বোধের সাথে নিজেকে একাকার করি আমি। কোন মানুষেরই উচিত নয় তার ভিটে মাটি ছাড়া, পৈত্রিক ভিটে ছাড়তে বাধ্য করা। যারা সেটা করে তারা যেমন অমানুষ, আর যারা পালিয়ে পরবাসে গিয়ে উদ্বাস্তু হয় তা কী কাপুরুষতা নয়? 
:



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন