মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভাষাবিদ পাণিনি : জীবন, গবেষণা ও মৃত্যু বিষয়ক কথামালা ৪ পর্বের লেখার পর্ব # ২ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২৯


বলা হয়, পাণিনি ছিলেন অহিগলমালা শিবের উপাসক। সেইজন্য তাঁকে "আহিক" বলা হয়েছে। অতএব, পাণিনির পুরো নাম হলো:-

"আহিক দাক্ষিপুত্র শালাঙ্কি শালাতুরীয় পাণিন্‌ পাণিনি"

এ নামের মধ্যে পাণিনির ইষ্ট,মাতা,পিতা, জন্মস্থান, গোত্র সবকিছুর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। পাণিনির আগে কি ব্যাকরণ ছিল না? ছিল। বেদের যে ষড়ঙ্গ অর্থাৎ ৬ টি অঙ্গ (শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত ও জ্যোতিষ) তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকরণ। বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, ভাষাতত্ত্ব, (Linguistics), উচ্চারণ বিধি বা (Phonetics ) এবং ব্যাকরণ শাস্ত্র(Grammar) এই তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাণিনির আগে মোট ৮ টি ব্যাকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হলো:- ঐন্দ্রং, চান্দ্রং, কাশকৃৎস্নং, কৌমারং,সারস্বতং , আপিশলং, শাকলং এবং শাকটায়নং। এর মধ্যে শাকটায়নং ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।
:
পাণিনি এইসব ব্যাকরণ ভালভাবেই পড়েছিলেন এবং এইসব ব্যাকরণ থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। তিনি এইসব ব্যাকরণের ভুল ধারণা গুলিকে বাদ দিয়েছেন এবং শেষ পর্য্যন্ত সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে বৈদিক ভাষা (ছান্দস) এবং আঞ্চলিক ভাষা ( লৌকিক) এই ২টি ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। এই ব্যাপারটি পৃথিবীর কোন ব্যাকরণে আগেও ঘটেনি এবং পরেও না।
:
পাশ্চাত্যের প্রাচীন ভাষা হল, প্রধানত গ্রীক ও ল্যাটিন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষা হল সংস্কৃত। ভারতে মোটামুটি প্রধান ভাষা হল ১৫ টি। এই ১৫ টি প্রধান ভাষার উৎপত্তি কিন্তু সংস্কৃত। সংস্কৃত সাহিত্যের যে ভাণ্ডার, তা অকল্পনীয়। এই সংস্কৃত সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ হলো ঋগ্বেদ। বেদোত্তোর যুগে পাণিনি তাঁর সমসাময়িক বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। বলা হয় পাণিনি হিমালয়ে গিয়ে ১৮ দিন ধরে শিবের তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজান।প্রতিবার ঢাক বাজানোর সাথে এক একটি নতুন শব্দের সৃস্টি হলো। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, নটরাজ মূর্ত্তি শিবের আর একটি প্রতিরূপ। নটরাজ মূর্ত্তি পৃথিবীর ছন্দ এবং তালের রূপক। ঢাকের শব্দ ছন্দ এবং তালের সমার্থক। তালবাদ্য থেকে কি বর্ণের সৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব? বলে রাখা ভাল প্রতিটি তালবাদ্যের বোল অথবা বাণী বিভিন্ন বর্ণের সাহায্যেই তৈরী হয়েছে। তবলার বোল ‍‌ : ‘ধিন ধাগে তেরে কেটে’, পাখোয়াজের বোল: ‘তেটে কতা গদি ঘেনে’, ঢোলের বোল: ‘টাক ডুমা ডুম্ ডুম্’ , খোলের বোল: ‘ঝাগুড় ঝাগুড় ঝিনি ঝিনি ঝিনি’, ইত্যাদি সব কিছুই বিভিন্ন বর্ণের সমাহার। তালবাদ্যের বোল অথবা বাণীর মাধ্যমে সমস্ত বর্ণকে প্রকাশ করা যায়।
:
নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজানর পর এক একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি হলো। প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি। শব্দগুলো হল-

১) অ ই উ ণ্ ২) ঋ ৯ ক্ ৩) এ ও ঙ্ ৪) ঐ ঔ চ্ ৫) হ য ৱ র ট্ ৬) ল ণ্ ৭) ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ ৮) ঝ ভ ঞ ৯) ঘ ঢ ধ ষ্ ১০) জ ব গ ড দ শ্ ১১) খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্ ১২) ক প য্ ১৩) শ ষ স র্ ১৪) হ ল্ ।

শিবের উপদেশে, পাণিনি এই শব্দগুলিকে ১৪ টি সূত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। এই ১৪ টি সূত্র শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র । এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। এই শিবসূত্রজালের জন্য পাণিনি বিখ্যাত, এবং তাই তিনি অন্যান্য বৈয়াকরণদের থেকে একেবারে আলাদা। শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা। সেজন্য, এটির আর ১ টি নাম সংজ্ঞাসূত্র। মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এগুলোকে আরো সংক্ষিপ্ত করলেন। 
-
নাম দিলেন:- প্রত্যাহার সূত্র। প্রত্যাহার মানে সংক্ষেপিত। এক বা একাধিক সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণটি জোড়া দিয়ে যে শব্দটি তৈরী হয় তাকে প্রত্যাহার বলে। যেমন ‘অণ্’ একটি প্রত্যাহার,যার অর্থ অইউ । অক্ একটি প্রত্যাহার যার অর্থ অইউঋ৯। আবার ‘অচ্’ প্রত্যাহারটির মানে অইউঋ৯এওঐঔ। প্রকৃতপক্ষে অণ্, অচ্, অল্, ইক্, উক্, জশ্, হল্ প্রভৃতি প্রত্যাহারগুলি এক ধরণের ‘কোড’বা ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি’(সাংকেতিক ভাষা) যার সাহায্যে পাণিনির ব্যাকরণের অনেক সূত্র তৈরী করা হয়েছে। পাণিনির ব্যাকরণে এরকম ৪৪ টি প্রত্যাহার আছে। প্রথম প্রত্যাহারটি ‘অণ্’ হওয়ায় শিবসূত্রকে অণাদি(অণ্-আদি) সূত্রও বলা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ‘অচ্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত স্বরবর্ণ এবং ‘হল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ‘অল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত বর্ণগুলি রয়েছে। সুতরাং ‘অল্’ মানে ALL বোঝা যেতে পারে। তাহলে শিবসূত্রজালের বিভিন্ন নামগুলি হোলো-

শিবসূত্র, মহেশ্বরসূত্, সংজ্ঞাসূত্র, প্রত্যাহারসূত্র ও অণাদিসূত্র। চর্তুদশ সূত্রের প্রত্যেকটির শেষে হসন্তযুক্ত যে বর্ণগুলি আছে সেগুলি ‘ইৎ’ হয়। পাণিনির ব্যাকরণের ভাষায় ‘ইৎ’ মানে লোপ পাওয়া, কিন্তু বিনষ্ট হওয়া নয়। উদাহরণ:- ‘অণ্’ মানে অইউ। এখানে ‘ণ্’ বর্ণটি ‘ইৎ’হয়েছে। সমস্ত প্রত্যাহারের শেষের বর্ণটি ‘ইৎ’ হবে, যা পৃথিবীর অন্য কোন ব্যাকরণেই নেই।
:


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন