সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারত গমন : স্বরূপ সন্ধান : যৌক্তিকতা আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে Part - ৬ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ১২ ]


হিন্দুদের এ দেশত্যাগের পাশাপাশি জনভারে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশে বিহারী আর রোহিঙ্গা আরেক বিরাট সমস্যা বাংলাদেশের। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ : 

:
বাংলাদেশে ভারতীয় বিহারিদের আগমন পর্ব :
:
৬০/৭০-এর দশকে বাংলাদেশে হিন্দি উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর ব্যাপক আগমন ঘটে। পুরানো ঢাকা কিংবা দেশের অন্যান্য স্থানে যে বনেদী মুসলমান পরিবারগুলো ছিল, তারা নানা কারণে আরবি এবং ফার্সির পাশাপাশি উর্দু চর্চা করত। তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভাষাও ছিল উর্দু। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দশকগুলোতে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে কাজ করার জন্য অনেক উর্দু ভাষাভাষী তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আসে। তাদের মধ্যে এক বিশাল অংশ ছিল বিহার থেকে আগত যারা প্রধানত রেল, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও অন্যান্য বেসামরিক পদগুলোতে যোগ দিয়েছিল। ঢাকা থেকে ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সৈয়দপুরে এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে ওয়ার্কশপ অবস্থিত। এ ওয়ার্কশপে কাজ করার জন্য ব্রিটিশরা বিহার থেকে প্রায় ৭০০০ জনকে এখানে নিয়ে এসেছিল। উল্লেখ্য সৈয়দপুর শহরটি সীমান্তে অবস্থিত।
:
১৯৪৭ সালে যখন উপমহাদেশ বিভক্ত হলো তখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির কয়েক মাসের মধ্যেই হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব্বে ২ কোটি লোক বাস্তুহারা হয় এবং ১০ লক্ষ লোক মারা যায়। ৭৫ হাজার মহিলা নির্যাতিত, ধর্ষিত ও গৃহহারা হয়। ১৯৪৭ সালের মধ্যে ৭২ লাখ মুসলিম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অভিবাসী হিসাবে গমন করে। অন্যদিকে ৫৫ লাখ হিন্দু ও শিখ ভারতে অভিবাসী হিসাবে যায়। এর মধ্যে ১৩ লাখ মুসলিম অভিবাসী পূর্ব পাকিস্তানে যায়, যাদের মধ্যে ১০ লাখ ছিল বিহার থেকে আসা। সেই সময়ে বিহারে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসী পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এছাড়া ব্রিটিশরা তাদের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কোন একটি দেশে যোগদানের সুযোগ করে দেয়। এ সুযোগ এবং ১৯৪৭ এর ঘটনা প্রবাহে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিম বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ)-য় চলে আসে বা আসতে বাধ্য হয়। এভাবে শুরু হয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নতুন পরিচয়ের আশায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের ভিন্নমুখী যাত্রা। বাংলাদেশে (তৎকালীন পাকিস্তান) আসা এ সকল অভিবাসীর বিরাট অংশ ছিল উর্দু ও হিন্দি ভাষী। তখন রাজনৈতিক কারণে এদেরকে উদ্বাস্তু না বলে মুহাজির হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এসব অভিবাসীরা আরবি এবং ফার্সির পাশাপাশি হিন্দি উর্দু চর্চা করত। তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভাষা ছিল উর্দু। এরা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার পাশাপাশি ভাষাগত ভিন্নতার মুখোমুখি হয়। বাংলা ভাষা কিংবা লিপি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এ কারণে এবং রাজনৈতিক নীতির কারণে এরা বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে চলে এবং দৃঢ় গোষ্ঠীগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে তারা সব সময় আলাদা থাকে। ফলে প্রথম থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে এরা বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন পড়ে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিহারীদেরকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিরোধিতা করে ও পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে ইউএনএইচসিআর ( United Nations High Commissioner for Refugees) ও আইসিআরসি (International Committee of Red Cross) তাদের নিয়ে কাজ করে। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই মানবিক সমস্যা মোকাবেলায় একাধিক চুক্তি করে। ইন্দো-পাক অ্যাগ্রিমেন্ট ১৯৭৩, জেস ট্রাইপার্টাইট অ্যাগ্রিমেন্ট অফ বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া, ১৯৭৪ এই চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আইসিআরসি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টার অংশ হিসেবে নাগরিকত্ব সর্ম্পকে জানতে চায়। বিহারিরা তারা পাকিস্তানে যাবার পক্ষে রায় দেয়। তখন বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের Stranded Pakistani (আটকে পড়া পাকিস্তানী) বলে অভিহিত করা হয়। ফলশ্রুতিতে বিহারীদের তথা হিন্দি উর্দুভাষী এ জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে পাকিস্তানে পুনর্বাসন করা হয় বা পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বাকিদের আইসিআরসি এর অধীনে বাংলাদেশের ৬৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়।
:
আইসিআরসি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৬৬টি ক্যাম্প স্থাপন করে। এর মাধ্যে ছিল ঢাকার মিরপুর (২৫টি) ও মোহাম্মদপুর (৬টি)। মোহাম্মদপুরের ৬টি ক্যাম্প হলো জেনেভা ক্যাম্প, টাউন হল ক্যাম্প, সিআরও ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প, কমিউনিটি সেন্টার ক্যাম্প এবং স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্প। ১৯৭৩ সালে আইসিআরসি এর বিদায়ের পর বাংলাদেশ সরকার ও বিডিআরএস (Bangladesh Red Crescent Society) এদের দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশে হিন্দি উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মূল সমস্যাটি নাগরিকত্ব সংক্রান্ত। তারা বাংলাদেশী, ভারতীয় না পাকিস্তানী? ২০০৩ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টের এক রায় অনুযায়ী ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের বিহারিরা বাংলাদেশী হবে।
:
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীগত সমস্যা ও বাংলাদেশে আগমন
:
১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লক্ষাধিক মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই বিশ বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছে। শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বীকৃত রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যাওয়া অস্বীকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। কক্সবাজারের নয়াপাড়া এবং কুতুপালং এলাকার দু'টি ক্যাম্পে ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। আরাকান রাজ্য থেকে গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের ফলে তাদের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। কঠোর নিবন্ধিকরণ আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ, ভূমি বাজেয়াপ্তকরণ, বার্মার বৌদ্ধদের অবস্থানের জন্য জোরপূর্বক উচ্ছেদকরণ, ২০০৬ সালের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকানের ৯টি মসজিদের আশেপাশে অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ এর জন্য দায়ী বলে ধারনা করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অবস্থান করছে বলে মনে করা হয়।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ




:

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন