রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ-ভারত জলযুদ্ধ : এদেশের নদীগুলো শুকানোর জন্যে কি সত্যিই ‘ফারাক্কা’ দায়ী? ২য় পর্বের লেখাটির ১ম পর্ব প্রবন্ধ : ২


জলমানবিক বাংলাদেশে জালের মত বিস্তৃত নদীগুলোর দু’তীরের মানুষের জীবন আসলে নদীকেন্দ্রীক। প্রধানত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান এই নদীগুলোর অধিকাংশই এদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। বলা হয়ে থাকে কমপক্ষে ৫৪-টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও শাখানদী-উপনদী নিয়ে তার সংখ্যা আসলে কয়েক’শর মত। নদী নির্ভরশীল বাংলাদেশের এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, শুকনো মৌসুমে ‘পানির স্বল্পতা’ এবং বর্ষা মৌসুমে ‘জলাধিক্য’ ও ‘নদীভাঙন’।

পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সরকারী-বেসরকারী নানা পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারের কারণে বিশ্বাস জন্মে যে যে, ‘‘শুকেনো মৌসুমে (শীতে) ফারাক্কা বঁাধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে এদেশের নদীগুলো শুকিয়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে, বিপরীত দিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত ‘তার পানি’ বাংলাদেশের দিকে ‘ঠেলে’ দিয়ে ভাটির এ দেশটিকে ডুবিয়ে মারছে’’। এ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বেশেষে কোটি কোটি মানুষ উপরে বর্ণিত কথাগুলো বিশ্বাস করার কারণে, তাদের বর্তমানে দুর্ভোগের জন্যে ‘ভারত’কে দায়ী করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। নদীসৃষ্ট আমাদের বর্ণিত দুর্ভোগ্যের জন্যে প্রকৃতপক্ষে ‘ফারাক্কা’ তথা ‘ভারত’ সত্যি কি দায়ী? না কেবলমাত্র প্রতিবেশী একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা টিকিয়ে রাখার এটি একটি ষড়যন্ত্র? বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে।

এদেশে প্রবাহমান নদীগুলোর প্রায় সবগুলোর উৎস ‘উজান’ তথা ভারতে এবং মোহনা তথা ‘মিলনস্থল’ বাংলাদেশে। যেমন গঙ্গার উৎস ‘গঙ্গোত্রী হিমবাহ’ এবং ব্রহ্মপুত্রের উৎস ‘মানস সরোবরে’। নদীর ধর্মানুযায়ী নদী তার প্রবাহিত গতিপথে সকল প্রকার বাঁধা ও অসমতা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে প্রবাহিত হয়। সৃষ্ট সর্পিল বাঁকের কারণে ক্ষয়ক্রিয়া তথা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। প্রথাগতভাবে নদীগুলোর জীবনকাল ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। উৎসে নদীগুলো ‘যৌবন’দীপ্ত তথা খরস্রোতা থাকলেও, বাংলাদেশে নদীগুলো মূলত তারুণ্য-যৌবন হারিয়ে ‘পরিণত’ বয়সে মন্থর ও বিসর্পিল বা বিনুনি আকতি নিয়ে এদেশে প্রবেশ করে এবং অনেক নদী কেবল ‘বার্ধক্যে’ এদেশে প্রবেশ করে বিধায় নাব্যতা হারায়। পলি ও মিহি বালুতে গঠিত নদীতীর, সাম্প্রতিক মজুতকৃত তীরের নরম পদার্থসমূহ ভাঙনের পক্ষে খুবই সংবেদনশীল।

তা ছাড়া এ অঞ্চল গঠনগত প্রকৃতি তথা নদীগুলো দক্ষিণমুখী, সর্পিল, চরোৎপাদী বা বিনুনি, সরলাকার, সূক্ষ্ম বালুকণাময় তলদেশ, নরম পলল গঠিত ভূমি, পরিমিত ঢাল, ভাঙনপ্রবণ তীর ও পরিবর্তনশীল নদীখাতজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে, উজান থেকে নদী ভাঙনজাত প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন মাটি-পলি বা উপজাত পদার্থ ‘ভাটি’তে নিয়ে এসে নতুন চরের সৃষ্টি করে, যে কারণে নদীগুলো চর সৃষ্ট কারণে ভরাট হয় এবং বর্ষায় পানি প্রবাহ উপচে অকাল বন্যার সৃষ্টি করে। এগুলো মূলত হয় নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে বদ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর ও পলিজাত উপভূমি সৃষ্টি হয়ে। এই নদীগুলো কেবল ভারত থেকে ২.৪ বিলিয়ন টন নরম মাটি-পলিই নিয়ে আসেনা, বর্ষামৌসুমে প্রবল জলস্রোতে অনেক ‘নুড়িপাথর’ বহন করে, যা বাংলাদেশে সিলেটসহ বেশ ক’টি জেলায় সংগৃহীত হয় এবং এদেশের নির্মাণ শিল্পে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে ভারতের নদী প্রবাহ আমাদের উপকারও করে বটে।

লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন