মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ৬ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২১ ]




মুক্তিবাহিনি গঠনেরও আগে, বাংলাদেশি গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে ভারত। এপ্রিলে মুক্তিবাহিনি গঠনের পর নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করার কাজটি মূলত ভারতিয় সামরিক বাহিনির ওপর গিয়ে পড়ে। ভারতের বেশ কিছু সামরিক কেন্দ্রে গেরিলা ও প্রচলিত কায়দায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যদিও বাংলাদেশের যুদ্ধকৌশল প্রণয়ন করতেন এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। মুক্তিবাহিনি ভারতিয় বাহিনির দ্বারা প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত হলেও সেনা সংগ্রহ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ছিল। বিষয়টি পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনির বিষয়ে ভারত সরকারের হতাশা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল। বস্তুত এ কারণে ভারত ‘মুজিব বাহিনি’ নামের আরেকটি বাহিনি গঠনের দিকে ধাবিত হয়।
:
মানবিক বিবেচনার বাইরেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে শরণার্থীদের বন্ধনের জায়গা ছিল ধর্মীয় পরিচয়ে। মুসলমান শরণার্থীদের তুলনায় হিন্দু শরণার্থীদের হার ছিল অনেক বেশি। কারণ পাকিস্তানি বাহিনির রোষের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাঙালি হিন্দুরা। যদিও কিছু রাজনৈতিক দলের উসকানি ছিল, তবু ভারতের সরকার ধর্মীয় পরিচয়ের এই দিককে বিশেষ আমল দেয়নি। ভারতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বেশ তাড়াতাড়ি এবং প্রকাশ্য অবস্থান জানায়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সজীব বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। পুঁজিপতিরা মনে করেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আগের মতো বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশ হবে ভারতিয় পণ্যের ‘স্বাভাবিক বাজার’।
:
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থনের শর্ত ছিল—এর নেতৃত্ব দেবে আওয়ামী লীগ। আনুষ্ঠানিক যুক্তি ছিল—যেহেতু আওয়ামী লীগ কিছুদিন আগেই সাধারণ নির্বাচনে জিতেছে, তাই দেশে-বিদেশে জনমত তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। আন্তর্জাতিক জনমত পক্ষে নিয়ে আসার জন্য ভারত দুটি নীতি গ্রহণ করে। প্রথমটি বাংলাদেশে বাম শক্তির উত্থাপনের আতঙ্ক ছড়ানো। বামভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে ভারত চেয়েছে বাংলাদেশ-প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন জানাক, নতুবা নিরপেক্ষ থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রবাসী হয়তো কমিউনিস্ট বাংলাদেশের থেকে তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়া কিংবা ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করাকেই ভালো মনে করবে। কিন্তু কেবল বামভীতি ছড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে টানা সহজ ছিল না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তখন নতুন মোড় নিচ্ছে। অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের নবায়ন এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্যকামী আকাঙ্ক্ষার জন্য হুমকি হওয়ার আশঙ্কা থেকে ভারতকে নতুন নীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। এই দ্বিতীয় নীতিটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করা। জুলাইয়ে ভারত সরকার দুই বছরের পুরোনো সোভিয়েত প্রস্তাব দ্রুত গ্রহণ করে নিরাপত্তাভিত্তিক মৈত্রি চুক্তিতে পৌঁছায়। এই চুক্তি ভারতের আশু লক্ষ্য পূরণে অন্তত একটি পরাশক্তির সমর্থন নিশ্চিত করে। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের জোগান দেওয়ার ব্যবস্থাও করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
:
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এই বিশেষ সম্পর্ক বাংলাদেশে ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ বাড়ায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক থাকলেও ভারতের আকাঙ্ক্ষা ঠেকাতে তখন তেমন কিছু করেনি। আন্তর্জাতিক সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়ায় ভারত শিগগির আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের পক্ষে প্রত্যক্ষ সামরিক সম্পৃক্ততায় যুক্তরাষ্ট্র যাবে না। ভারত-সোভিয়েত চুক্তির ফলে সেই সম্ভাবনা আরও কমে যায়। 
:
মধ্য-একাত্তর নাগাদ ভারতিয় শাসকশ্রেণি আপাত বিপরীতমুখী দুই নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মতি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু সর্বাত্মক স্থল অভিযান শুরু করার জন্য বর্ষাকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সামরিক সরঞ্জাম আসা সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ও ছিল। নভেম্বরের শেষে ভারতের জন্য সামরিক ও কূটনৈতিক উভয় দিক থেকে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। 



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন