মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ছিটমহল সমস্যার সমাধান। দু-দেশের লাখো মানুষের কান্নার কি অবসান হচ্ছে? : ৪ [ ভারত বাংলাদেশ রিলেটেড প্রবন্ধ # ৩৬ ]

স্বাধিন যুগে পরাধিন মানুষের অবরুদ্ধ জীবন :



ছিটমহলবাসীরা বাস্তবে নিজদেশে পরবাসী। তাদের নাগরিকত্ব কার্যত নামমাত্র নাগরিকত্ব। নিজেদের মূল দেশের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই। এ যেন ক্যাম্প-বন্দি জীবন। দেশের পরিচয়ে তারা বাংলাদেশের মানুষ, অথচ থাকতে হয় ভারতের ভেতর। আবার তারা ভারতের মানুষ, বসবাস বাংলাদেশের ভেতর। কিন্তু বাস্তবে এরা দেশহীন, নাগরিকত্বহীন। বেশ ভিন্নরূপে হলেও এগুলো যেন হয়ে আছে বাংলার ফিলিস্তিন। কোন দেশেরই যেন এদের প্রতি কোন দায়দায়িত্ব নেই। বাস্তবে এরা যাপন করছে ছিটের মানুষপরিচয় নিয়ে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থারগুলোরও কোন তৎপরতা সেখানে নেই। শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয়জল, রাস্তাঘাট, যানবাহনের তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা সেখানে নেই; নেই ব্যাংক, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পাকা সড়ক, সেতু, হাটবাজার ইত্যাদি। ছিটমহলগুলোতে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। সেখানকার ৯০ শতাংশের বেশী মানুষ অক্ষর জ্ঞান শূন্য। অবহেলা, অবিশ্বাস আর হয়রানি তাদের নিত্যসঙ্গী। অবরুদ্ধ জীবন যাপনের কষ্ট, যাতায়াত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার কষ্ট, নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতার কষ্ট, সব মিলে দীর্ঘশ্বাসে ভরা অনিশ্চিত তাদের জীবন।
:
ছিটমহলগুলোয় অপরাধ বেড়ে চলছে, দাগি অপরাধীদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। আইনি জটিলতার কারণে কোনো দেশের পুলিশই ছিটমহলে প্রবেশ করে না। তাছাড়া ছিটমহলে প্রশাসনেরও নেই কোনো কর্তৃত্ব। নারী পাচার, মাদক পাচারের রুট হয়ে আছে ছিটমহলগুলো। ফসল নিয়েও দুশ্চিন্তায় থাকে এখানকার অধিবাসীরা; অনেকেই জিরো লাইনে ফসল চাষ করতে যায় না। অনেক সময় আবার সন্ত্রাসীরা গরু-বাছুর, ফসল নিয়ে যায়। ভয়ে কিছুই বলতে পারেন না অসহায় ছিটবাসীরা। রাষ্ট্রের অধিকার বনাম মানবাধিকার
ছিটমহল বিনিময় নিয়ে প্রধান যে আইনগত জটিলতার কথা ওঠে সেটি হলো: একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কী করে তার জমি অন্যদেশকে দিয়ে দিতে পারে? কিন্তু রাষ্ট্রের এই জমির অধিকারের চেয়ে ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী মানুষদের অধিকার কি বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়? রাষ্ট্রের অধিকারের কাছে কি মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে? তবে আশার কথা এই যে, ভারত এবং বাংলাদেশ বিনিময়ের জন্য সম্মত আছে।
:
যারা ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা তাদেরও নৈতিক কর্তব্য আছে। জাতিগতভাবে এই ছিটমহলগুলির অধিবাসীরা বাঙালী আমাদেরই স্বজন। আমাদের কর্তব্য হলো আমাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা যেন ছিমহল বিনিময়ে অযথা বিলম্ব না হয়। আমাদের কর্তব্য বিষয়টিকে রাজনৈতিক দিক থেকে না দেখে মানবিক দিক থেকে দেখা এবং নিজ নিজ সরকারকে ছিটমহল বিনিময়ে পূর্ণ সমর্থন দেয়া। প্রয়োজন হলে নতুন আইন করা হোক, সংসদে তা পাশ করা হোক, তবুও বিনিময় কাজটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুসারে বাস্তবায়িত হোক। দুদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে
:
আসামকে অন্তর্ভুক্ত রেখেই ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা মঙ্গলবার সীমান্ত চুক্তির বিল অনুমোদন দিয়েছে। ফলে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিল মোদির সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। এরমধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। ফলে দুই দেশের ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্তের রেখাও টানা হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দুদেশের মানচিত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
:
সীমান্ত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ১৭ হাজার একরের কিছু বেশি জমি বাংলাদেশ পাবে। ভারত পাবে সাত হাজার একরের সামান্য বেশি জমি।
:
বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলেই সীমান্ত চুক্তি পাস করতে রাজ্যসভায় বিল উত্থাপন করেছিল। কিন্তু তখন বিজেপি এই চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে বিল পাস হয়নি বটে তবে রাজ্যসভায় কোনো বিল উত্থাপন হলে তা থেকে যায়। ফলে বিলটি রাজ্যসভায় এখনও আছে। এখন তা পাসের জন্য আজকের কার্যসূচিতে নেয়া হচ্ছে। এক সময় চুক্তির বিরোধিতাকারী বিজেপি এখন যুক্তি দেখাচ্ছে, এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশবন্ধ হবে। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন সম্ভব হবে। তবে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের আগে ভারত তার প্রতিশ্রতির একটি বাস্তবায়ন। এতে করে মোদির সরকার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেক্ষেত্রেও অগ্রগতির আশা করছে দিল্লি। এমন হলে মোদির সফরে আরও অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হতে পারে। যদিও মোদির সফরের আগে আরেক প্রতিশ্রুতি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
:
৮ মে লোকসভার চলতি অধিবেশন শেষে চীন, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। এরপর জুন বা জুলাইয়ে বাংলাদেশে আসতে চান তিনি। তবে ভারতীয় কূটনীতিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘খালি হাতেঢাকা সফরে যাওয়া মোদির ঠিক হবে না। এ কারণে লোকসভার চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস করিয়ে আনতে মোদির এই তাড়াহুড়ো। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।



এর পর জানতে চাইলে দেখুন পর্ব # ৫ (শেষ পর্ব)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন