কোচ বিহার রাজ্য থেকে জেলা যেভাবে :
:
পাল রাজবংশের পতনের পর তের শতকে কামরূপ রাজ্য ভেঙ্গে পশ্চিম অঞ্চলে
কামতা ও পূর্বে অহম রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। কামতা প্রথমে খেন’দের দ্বারা শাসিত হয়। পরে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (রাজত্বকাল
১৪৯৪-১৫১৯) তাদের তাড়িয়ে দিয়ে কামতা দখল করে নেয়। কিন্তু হুসেন কামতায় তার
নিয়ন্ত্রণ পাকা করতে পারেনি। সেখানকার সামন্তদের কাছে তিনি হেরে যান। কোচ বংশের
বিশ্ব সিংহ নেতৃত্বের এই শূন্যতা পূরণ করে ও কামতায় কোচ রাজবংশের গোড়া পত্তন করে।
মোগল সম্রাট আকবরের আমলে এই কামতা রাজ্য ভেঙ্গে যায়। পশ্চিমে কোচ হাজো ও পূর্বে
লক্ষ্মী নারায়ণের (রাজত্বকাল ১৫৮৭-১৬২১) শাসনে কোচ বিহার রাজ্যের পত্তন ঘটে। কোচ
বিহার একটি প্রভাবশালী রাজ্যে পরিণত হয় এবং মোগলদের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে
সমর্থ হয়েছিল। মোগলদের সাথে কোচ বিহার সন্ধি করে এবং বাংলার সালতানাত দখলে
মোগলদেরকে সহায়তা করে। অবশ্য নিজ রাজ্যের অনেক অংশও মোগলদের কাছে হারাতে হয়েছিল
কোচ বিহারকে। পরবর্তীতে ভুটানের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে কোচ বিহার ইংরেজদের সাথেও
সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখে। মোট কথা, কোচ বিহার
প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে তথাকথিত স্বাধীনভাবে ইংরেজ আমলটিও পার করেতে পেরেছিল। ১৯৪৯
সালে রাজ্যটি ভারতে যোগ দেয় এবং পরের বছর তা পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়।
:
ছিটমহলের ইতিহাসের শুরু রংপুর অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার পর।
আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ ষোল শতকে (১৫৭৫ সালে) রংপুর অঞ্চলের কিছু অংশ জয় করে।
সতের শতকে (১৬৮৬ সালে) এই পুরো অঞ্চলটি মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং
ঘোড়াঘাট ‘সরকার’য়ের অধীনে ন্যস্ত হয়। অর্থাৎ তখন রংপুর অঞ্চল মোগলদের অধীন এবং তার
উত্তরে স্বাধীন কোচ রাজার রাজ্য।
:
কোচ রাজাগণ এবং রংপুরের মহারাজাগণ মূলত ছিল সামন্ত। তাদের মধ্যে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, ছিল ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যে মহলের বিনিময়। বলা হয়ে থাকে, সেই মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও
মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তার পাড়ে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশ্যে। খেলায় বাজি ধরা হতো
বিভিন্ন মহলকে যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হারজিতের মধ্য দিয়ে এই
কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সাথে সাথে বদলাতো সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানা।
এভাবেই নাকি সেই আমলে তৈরি হয়েছিল একের রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিট মহল।
:
আজকের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমস্ত ভূমি ব্রিটিশ রাজের
অন্তর্গত ছিল না। প্রায় ৪০ শতাংশ ছিল বিভিন্ন তথাকথিত ‘স্বাধীন রাজ্য’
যেগুলিকে বলা হতো ‘নেটিভ স্টেট’ বা ‘প্রিন্সলি স্টেট’। এ রাজ্যগুলি কার্যত ছিল ব্রিটিশদের অধীন তবে অভ্যন্তরীণ
বিষয়াদিতে রাজাদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। হায়দ্রাবাদের নিজামের মত কোচ রাজাও
ব্রিটিশদের নেটিভ স্টেট-এর রাজা হিসেবে থেকে যান। ভারত ভাগের সময় এরূপ রাজ্যগুলিকে
স্বাধীনতা দেয়া বা ভাগ করার এখতিয়ার ব্রিটিশ রাজের ছিল না।
:
১৯৪৭ সালে ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এক্ট-১৯৪৭’ পাশ করে। এ আইন
অনুসরণ করে সেই বছরেই ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশ রাজ বিলুপ্ত হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে
দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। প্রণীত আইনে বলা হয়, উপমহাদেশের ‘স্বাধীন’ অঞ্চলগুলোর নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়া সুযোগ
থাকবে অথবা তারা স্বাধীন সত্তা নিয়েও ইচ্ছে করলে থাকতে পারবে। রাঙামাটির রামগড় ও
বান্দরবান পূর্ব পাকিস্তানের সাথে এবং পূর্ব সীমান্তের পার্বত্য ত্রিপুরা ও
উত্তরের কোচ বিহার ভারতের সাথে যুক্ত হয় তাদের ইচ্ছানুসারে। অন্য কোন রাজ্যে জমি
নিয়ে সমস্যা না ঘটলেও সমস্যা বাঁধে কুচবিহারে। তখনকার কোচ রাজা জগদ্দীপেন্দ্র
নারায়ণের কিছু জমিদারি স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মধ্যে। একইভাবে
রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারের কিছু তালুক ছিল কুচবিহার সীমানার ভেতর। এ নিয়ে
জমিদারদ্বয় কোন সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন।
:
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের উদ্দেশ্যে সীমানা নির্ধারণকল্পে সিরিল
রেডক্লিফ’কে সভাপতি করে কমিশন গঠন করা হয়। তিনি ছিলেন একজন আইনবিদ, দেশের সীমানা নির্ধারণের মত কাজে তার কোন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছিল
না। কমিশনের অন্য সদস্যদেরও একই হাল ছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত ব্রিটিশ সরকারের না ছিল উদ্যম,
না ছিল তার হাতে সময়। ১৯৪৭ সালের
৮ জুলাই তিনি ভারতে আসেন এবং মাত্র ছয় সপ্তাহের কাজ করে ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা
নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশের সীমারেখা নির্ধারণ প্রভাবিত
হয়েছে। কমিশন কোচ বিহার ও রংপুর এলাকার ছিটমহলগুলো নিয়ে কোন সমাধানে আসতে পারেনি
এবং ছিটমহলগুলো বজায় রাখে। এভাবে রেডক্লিফের অংকিত ম্যাপ অনুসারেই শেষ পর্যন্ত
ভারত ভাগ হয় ও ছিট মহলগুলো থেকে যায়। ১৯৪৭ সালের পরপরই ছিটমহল সমস্যা সমাধানে
ভারত-পাকিস্তান উদ্যোগী হলেও তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এগুনো সম্ভব হয়নি।
এর পর জানতে চাইলে দেখুন পর্ব # ৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন