মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সন্ধান : ইন্দিরাগান্ধী, ভারতরাষ্ট্র আর সোভিয়েত সহযোগিতার অকথিত কথামালা পর্ব # ৯ [ বাংলাদেশ ভারত রিলেটেড প্রবন্ধ # ২৪ ]



বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধ অঘোষিতভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি জিয়ো স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছিল চীনা ও পাকিস্তানি বাহিনির গতিবিধি সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। ভারত আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সেসব তথ্য জানতে পারছিল। আগে থেকেই চীন সীমান্তে ৪০ ডিভিশন রুশীয় সৈন্য মোতায়েন করা ছিল। সেখানে রুশীয়রা আরো সেনা মোতায়েন করতে শুরু করল। এমন অবস্থায় চীনারা যে পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসবে না, তা নিশ্চিত হয়ে ভারত নেফা অঞ্চল থেকে তাদের মাউনটেন ডিভিশনের সৈন্যদের সরিয়ে এনে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োজিত করল।
:
রাশিয়া তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানত, বিশ্বের যেখানেই সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দেয়, সেখানে স্বার্থ জড়িত থাকলে আমেরিকা সব সময় বিমানবাহী জাহাজসহ তার নৌবহর পাঠিয়ে দিয়ে থাকে। ওই অভিজ্ঞতার আলোকে নভেম্বরের শেষদিকে রাশিয়া ষষ্ঠ নৌবহর, রুশীয় ভাষায় “শেসতাই ফ্লোত”কে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে পাঠিয়ে দিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভেটো প্রদান ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলাদেশে ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে কামান-বন্দুকের যে যুদ্ধ হচ্ছিল, নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধ তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। নিরাপত্তা পরিষদের চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া বক্তৃতার নামে বেশ ভাঁড়ামি করেছিল। সে জানত বাংলাদেশের যুদ্ধে চীন কোনো অবস্থায়ই জড়াবে না। তাই সে খুব জোরালো বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানকে খুশি করার চেষ্টা করল। সে বঙ্গবন্ধুকে তার বক্তৃতার একপর্যায়ে কুইসলির সঙ্গেও তুলনা করল। এ ছাড়া হুয়াং হুয়ার বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাত কচলানোর অভ্যাস ছিল।
:
রুশ প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক হুয়াং হুয়ার বক্তৃতার প্রত্যুত্তরে বললেন, মি. হুয়াং হুয়া যত খুশি হাত কচলাতে পারেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু তাঁকে আরো ভালো করে ইতিহাস পড়তে হবে। কুইসলির ইতিহাস হুয়াং হুয়ার ভালো করে জানা নেই। পৃথিবীর তাবৎ কুইসলি-নাৎসি-ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছিল সোভিয়েত জনগণ। জ্যাকব মালিক চীনা প্রতিনিধি, মার্কিন প্রতিনিধিদের প্রস্তাব তিনবার ভেটো দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনবার ভেটো প্রয়োগের পর জ্যাকব মালিক রাশিয়ার প্রস্তাব পেশ করলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যদের পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাব পাস করা না হলে অন্যদের যেকোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে তিনি ভেটো প্রদান করে তা প্রতিহত করবেন। নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে কিছু করার উপায় নেই দেখে নিঙ্ন-কিসিঞ্জার গানবোট ডিপ্লোম্যাসির আশ্রয় নিলেন। 
:
তাঁরা আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন, সেইসঙ্গে পাকিস্তান সরকারকে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সংবাদ জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন। ইতিমধ্যে সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য রাশিয়া আরো একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করল মহাকাশে।
:
সপ্তম নৌবহরের যাত্রা করার খবর লাভ করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে জেনারেল নিয়াজিকে জানিয়ে দেওয়া হলো, শিগগিরই দক্ষিণ দিক থেকে আমেরিকার সাহায্য এসে পেঁৗছাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনির বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থীদের, রাজাকারদের মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য সপ্তম নৌবহরের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত হচ্ছে জানতে পেরে বাংলাদেশের পাকিস্তানি সমর্থকদের মনোবল সত্যি সত্যি খুব চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করল। তারা বলাবলি করতে শুরু করল, এবার ভারত বুঝবে, যুদ্ধ কাকে বলে!
:
মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রণালী পেরিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছিল বে অব বেঙ্গলের দিকে, তখনই মার্কিনিদের গোয়েন্দা উপগ্রহের ক্যামেরায় বঙ্গোপসাগরে আগে থেকে মোতায়েন করা “শেসতাই ফ্লোতের” উপস্থিতি ধরা পড়ল। তা ছাড়া সৌভিয়েত পারমাণবিক শক্তিচালিত ৪০-নৌবহরের বিশাল ফ্লিটকে সৌভিয়েত সরকার জরুরি বার্তা পাঠালো তারা যেন পীত সাগর, চীন সাগর, আর ভূমধ্য সাগর থেকে ধাবিত হয় বঙ্গোপ সাগরের দিকে। যাতে লজ্জিত ছিল ডেস্ট্রয়ার, টর্পেডোসহ আধুনিক সহ সমরাস্ত্র, যা প্রতিরোধে সক্ষম ছিল মার্কিন ৭ম নৌবহনরকে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিঙ্ন-কিসিঞ্জার যুগলের কাছে সে সংবাদ পেঁৗছে গেল এ সংবাদ। তাঁরা বুঝে উঠতে পারলেন না, এবার কী করা যায়? সুস্থভাবে চিন্তা করার জন্য তাঁরা সময় নিলেন। সপ্তম নৌবহরের গতিবেগ ২৪ ঘণ্টার জন্য নিশ্চল করে রাখা হলো।
:
শেসতাই ফ্লোতে ছিল ২১টি রণতরী। এর মধ্যে কয়েকটি পারমাণবিক ডুবোজাহাজসহ ছিল অন্যান্য রণপোত। ওইসব রণপোত যেসব মিসাইল বহন করছিল তার একটির আঘাতেই সপ্তম নৌবহরের বিমানবাহী জাহাজের সলিল সমাধি ঘটানোর ক্ষমতা ছিল। শেসতাই ফ্লোতের বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশি খবর রাখত। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজে এই মহাক্ষমতাশালী নৌবহর সম্পর্কে একদম চুপচাপ ছিল। সপ্তম নৌবহর যখন পূর্ণগতিতে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবমান, তখন মার্কিনি গোয়েন্দা উপগ্রহের ক্যামেরায় শুধু শেসতাই ফ্লোত তার একটু পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। ২৪ ঘণ্টা চিন্তা-ভাবনা করার পর একান্ত মুখরক্ষার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিহিকণ্ঠে ঘোষণা করল, সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশ থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতেই বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু ওই নৌবহরের গতি এমন মন্থর করে দেওয়া হলো যে তত সময়ে পাকিস্তানি বাহিনি বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
:


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন