বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (Rivers Interlinking Project of India) পর্ব : ২ [ ৪৯ ]



ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (Rivers Interlinking Project of India)
=================================================
২ পর্বের বড় লেখার শেষ পর্ব (Part # 2)
============================
 
[প্রথম পর্বের লিংক : https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1712941655606650&set=a.1381466915420794.1073741828.100006724954459&type=3&theater]
================================================
 
প্রকল্পের ঋণাত্মক-ধনাত্মক দিক : বিশেষজ্ঞ আর সমালোচনগণ যা বলেন
================================================
ভারতের বর্তমান সরকার প্রকল্পটি জোরেশোরে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। এরই মধ্যে জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার সভাপতি সাবেক সচিব বিএন নাভালাওলা। এ প্রকল্পের পরিবেশগত এবং প্রতিবেশগত প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভারতের বুদ্ধিজীবিমহল এবং পরিবেশকর্মীরা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রথমত: তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই বিশাল প্রকল্পের ইতিবাচক দিকসমূহ এবং পরিবেশগত ঝুঁকিসমূহ যথাযথ নীরিক্ষা করা হয়নি। দ্বিতীয়ত তারা দাবি করছেন যে, এই প্রকল্পের ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন এলাকাসমূহ মরুকরণের শিকার হবে।
: 
কেন-বেতোয়া প্রকল্প নিয়ে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে রয়েছে বিবাদ। বিবাদের অনেকগুলো দিক রয়েছে: প্রথমত. কেন অববাহিকার প্রায় ৮৭ ভাগ পড়েছে মধ্যপ্রদেশে - ফলে এখান থেকে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনায় তারা উদ্বিগ্ন। দ্বিতীয়ত, যে সংযোগ খালের মাধ্যমে এই পানি বেতোয়া অববাহিকায় নিয়ে যাওয়া হবে, তার ৩২৩ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১৮ কিলোমিটার পড়েছে উত্তর প্রদেশে। অর্থাৎ খালের জন্য যেসব জমি নষ্ট হবে, তার প্রায় পুরোটাই যাবে মধ্যপ্রদেশের। প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ২১৩৫ হেক্টর যাবে মধ্যপ্রদেশ থেকে এবং মাত্র ১৮০ হেক্টর যাবে উত্তর প্রদেশ থেকে। ফলে উচ্ছেদ হওয়া গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগকে পুনর্বাসন করতে হবে মধ্যপ্রদেশে। 
:
প্রত্যক্ষ স্বার্থগত ওই বিবাদের পাশাপাশি প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়েও বহু ভারতীয় সন্দিগ্ধ। এরূপ সন্দেহের অন্যতম বিষয় উদ্ধৃতপানির ধারণা। ভারতের প্রভাবশালী সাময়িকী ফ্রন্টলাইন’-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে (৭-২০ এপ্রিল ২০১২) অল ইন্ডিয়া পিপলস্ সায়েন্স নেটওয়ার্কের সভাপতি ডি. রঘুনাথন বলেছেন, ‘উদ্ধৃত্ত কথাটি তৈরি হয় সাপ্লাই-ডিমান্ডের উপর ভিত্তি করে। গঙ্গা অববাহিকায় জলের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা সম্পর্কে কোন নিরপেক্ষ স্টাডি ছাড়াই ধরে নেয়া হচ্ছে, সেখানে বেশি জল প্রবাহ আছে এবং তা সরিয়ে নেয়া যেতে পারে। এই অববাহিকায় যখন আরও অধিক চাহিদা তৈরি হবে, তখন এই মেগাপ্রকল্প কী কাজে লাগবে? সকল অববাহিকাতেই পানির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। 
:
এ প্রকল্পের ফলে কী-কী লাভ হবে - সেটা নিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা সপ্তপদি কথা বললেও, এর ফলে কী-কী সামাজিক ক্ষতি হবে ও সংকট তৈরি হবে, তার ওপর কোন সমীক্ষা চালানোর কথাও এখন আর কেউ বলছে না। পুরো আন্ত:নদী প্রকল্পের আওতাধীন কমবেশি প্রায় ১০-হাজার কিলোমিটার কৃত্রিম খাল তৈরি করতে গিয়ে যে পরিমাণ মানুষকে জোর করে বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ করে বাস্তুহারা করতে হবে, তার ওপরও কোন সমীক্ষা হয়নি এখনো। গবেষকদের অনুমান, এতে প্রায় ৫০-৬০ লাখ মানুষকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে। অধিকাংশই যারা কৃষক ও আদিবাসী তথা দলিত । যার প্রভাব দেখা যাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরই। এইরূপ উচ্ছেদের ফলে কেবল যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা নয় - বিভিন্ন জনপদের বিপুল সাংস্কৃতিক ক্ষতিও ঘটে তাতে। বড় আকারে উচ্ছেদের মধ্যদিয়ে শত শত বছর জুড়ে গড়ে ওঠা একটি জনগোষ্ঠীর পুরো সাংস্কৃতিক ও গোষ্ঠীগত অবকাঠামো তাৎক্ষণিকভাবে ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়ে। ভারতে গত ৫০-বছরে বিভিন্ন ড্যাম, বিদ্যুত কেন্দ্র ও মেগা নির্মাণ কাঠামোর কারণে এভাবে প্রায় প্রায় ৫ কোটি মানুষের জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
:
ভারতীয় পরিবেশ বিশেজ্ঞদের বড় উদ্বেগের কারণ হলো, পান্না জেলায় ভারতের যে টাইগার রিজার্ভ পার্করয়েছে, সেই বনভূমির বিরাট এলাকা প্রকল্পের কাজের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। সরকারিভাবেই স্বীকার করা হচ্ছে যে, ,৪০০ হেক্টর বনভূমি নষ্ট হবে এই প্রকল্পে। এছাড়া এই প্রকল্পের কৃত্রিম খালের জন্য বহু মানুষকে উচ্ছেদও হতে হবে। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত ১০টি গ্রামের ৮,৫৫০ মানুষ উচ্ছেদ হওয়ার আশংকার কথা কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সচরাচর এটাও বলে থাকেন যে, প্রত্যেক নদীর অববাহিকার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা সেই নদীর অববাহিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের এসব বক্তব্য শুরু থেকে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এর ফলে সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা, প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা হবে তার নিজ এলাকা আর বসতি থেকে। পাশাপাশি নদীতে পলি প্রবাহ ও মৎস সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ডুবে যাবে অসংখ্য বন আর খোলা মাঠ। আরো একটা অভিযোগ আছ যে, এ প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবেদনই জনসম্মুখে আনা হয়নি। কারণ হিমালয় উপত্যকার দেশগুলোতে আন্ত:সীমান্ত নদী একটি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। কেবলমাত্র কেন-বেতওয়া লিংক নিয়ে একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা হয়েছে। এই লিংকের মাধ্যমে কেন নদীর অতিরিক্ত জল একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে বেতওয়া বেসিনে সরাবরাহ করা হবে, যেটির অবস্থান উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে।
:
এ নিয়ে মামলা হয় ভারতীয় উচ্চ আদালতে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রিয় সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আদেশ দেয়। একইসঙ্গে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে দেয়ার জন্য কেন্দ্রকে পরামর্শ দেয় যাতে করে প্রকল্পটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওই আদেশে বলা হয়েছিল, ‘কয়েকটি বাদে মোটামুটিভাবে প্রায় সবগুলো রাজ্যই এ প্রকল্পের পক্ষে রয়েছে।বিশেষজ্ঞ গোপাল কৃঞ্চা অনেক দিন থেকেই নদী সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তার মতে, ওই সময় আদালতকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে সাতটি রাজ্যই এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আদালতে এফিডেভিট দাখিল করেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য আসাম ও সিকিম এবং দক্ষিণের রাজ্য কেরালা প্রকল্পের বিরোধীতা করেছে। এই রাজ্যগুলোর দাবী, নিজেদের জলসম্পদের উপরে তাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি। রাজস্থান, গুজরাট ও তামিল নাডুর মতো রাজ্যগুলো ব্যাপক জলসংকটে ভূগছে। এসব রাজ্যের আভ্যন্তরীণ জলসম্পদ এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। 
:
ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ি নিজস্ব জলসম্পদের উপরে পূর্ণাঙ্গ আইনগত অধিকার রাজ্য সরকারের। অন্যদিকে যেসব নদী একাধিক রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সে বিষয়ে আইনগত সিদ্ধান্তের অধিকার কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের। আদালতে জল ভাগাভাগি নিয়ে এক রাজ্যের বিরুদ্ধে আরেক রাজ্যের বিস্তর অভিযোগ জমা পড়ে আছে বছরের পর বছর। 
:
মহারাষ্ট্র ও গুজরাট নিজেদের মধ্যে পার-তাপি-নমর্দা লিংকের মাধ্যমে জল ভাগাভাগির ব্যাপারে পিছিয়ে গেছে। রাজ্য দুটির জনগণের বিরোধীতায় এটি আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ দুটি রাজ্যেই ক্ষমতায় রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এই লিংকের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের ওয়েষ্টার্ণ ঘাট থেকে জল অপসারণ করে গুজরাটের মরু অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে। এর জন্য খনন করতে হবে প্রায় চারশকিলোমিটার দীর্ঘ খাল ও সাতটি বড় জলাধার। দুপক্ষের মধ্যে এনিয়ে ২০১০ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। কিন্তু এখন মহারাষ্ট্র এ প্রকল্পটি নিয়ে কোনোভাবেই এগুতে চাইছে না।
:
এ নদীসংযোগ পরিকল্পনা আবার গড়ে উঠেছে এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে যে, ভারতের কিছু অববাহিকায় উদ্বৃত্ত পানি রয়েছেএবং সেখান থেকে তা পানির অভাবগ্রস্ত অববাহিকায় নেয়া যেতে পারে। এইরূপ প্রকৌশলগত চিন্তার প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন ১৯৬৩-৬৪ সালে খ্যাতনামা সেচ ও বিদ্যুতমন্ত্রী ড. কানুরি লক্ষণ রাও। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট ও মরুকরণের মুখে পানিকেন্দ্রীক ওই ভাবনা এবং ১৯৮২ পরবর্তী উদ্যোগসমূহ স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে ব্যাপক সমর্থন পায়। এই ধারণার সমর্থকরা তখন থেকে বলছে, এটা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত নতুন করে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত করা যাবে এবং অনেক প্রদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণও সহজ হবে। অত্যধিক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে প্রথম থেকে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক সন্দেহ ছিল। এমনকি গঙ্গার শাখানদী হিসেবে মহানদি, গোদাভারী ইত্যাদিতে উদ্ধৃত্তপানি থাকার যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই মেগা প্রকল্পের অভিযাত্রা - তার যথার্থতা সম্পর্কেও এখনো কোন পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ গবেষণা ও জরিপ হয়নি সেখানে। 
:
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে যে নদীগুলোর পানি বাড়তিহিসেবে অযথাই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়ে অপচয়হচ্ছে, ভারতের গোটা হিমালয় অঞ্চলের জনগণ ও প্রকৃতির জন্য কিংবা গঙ্গাব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাটির দেশ বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাই অপরিহার্য, কারণ নদী অববাহিকার জনগণ ও প্রকৃতির কাছে নদী কেবল কিউমেক/কিউসেকে পরিমাপ যোগ্য পানির আধার নয়, নদী একটি প্রবাহমান জীবন্ত সত্ত্বা যার সজলসজীববাঁধাহীন অস্তিত্বের উপরই নির্ভর করে গোটা অববাহিকার কৃষিমৎসবনাঞ্চলজলাভূমি সহ সমগ্র জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক সজীব অস্তিত্ব।
:
ভারত ছাড়াও এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জলতাত্ত্বিক (Hydrologic) মানচিত্র আমূল বদলে যাবে নিশ্চয়ই। পানি এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে হিমালয় অঞ্চলে পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক বাঁধ নির্মিত হবে। এ সকল বাঁধের মাধ্যমে হিমালয় থেকে আগত নদীসমূহের পানি প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভূমিরূপ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি ইত্যাদির উপর সঙ্গত কারণেই প্রভাব পড়বে। গঙ্গা বিশ্বের অন্যতম একটি দূষিত নদী। নদীটির দূষণ রোধে যথেষ্ট জলপ্রবাহ থাকা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নদীর জল উত্তর প্রদেশের কাণপুরে পৌছার আগেই এর ৯০ শতাংশ জল অপসারিত হয়ে যায় কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য। এর অর্থ হচ্ছে নদীটি এর সমগ্র গতিপথের এক তৃতিয়াংশ শেষ করার আগেই এর জল শেষ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি গঙ্গার জল অন্যান্য নদীতে অপসারিত হয়ে চলে যায় সেক্ষেত্রে ক্লিন গঙ্গার স্বপ্ন অধুরাই রয়ে যাবে। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভারতীয় সমাজবাদি মনোজ মিশ্র। তিনি বলেন, ‘এটি আসলে একটি পরস্পরবিরোধী নীতি। একদিকে বলছে, গঙ্গাকে তারা নতুন করে প্রবাহমান করে তুলবেন, আবার অন্যদিকে আবার বলছেন নদী সংযোগের কথা। নদী তো আসলে কোনো পাইপ-লাইন নয় যে, তাকে সংযুক্ত করা যাবে। প্রকল্পটি নিয়ে বেশ আশাবাদী ভারতের কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী ঊমা ভারতী। সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আন্ত:নদী সংযোগ (আইএলআর) প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে রয়েছে। তার মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশে নৌ চলাচলের ক্ষেত্রে উন্নতি হবে।
:
বাংলাদেশ ও ভারতে জল আর নদী একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। চাহিদা মেটাতে দেশ দুটোকে অনেকাংশে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাই যৌথ নদীর জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রের রাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন দ্বন্দ্ব লেগে থাকে ভারতে, তেমনি আছে রাজনৈতিক বাংলাদেশের সাথেও। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের উচিত হবে, এ বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে পাশে রাখা, যাতে ভারত থেকে ৫৪-টি প্রবাহমান নদী যা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মূলত ভারত থেকে, তার প্রবাহে যেন বিঘ্ন না ঘটে। ইসিভুক্ত দেশগুলো যেমন ক্রমান্বয়ে তাদের সিমান্তরক্ষী, টাকার নোট, পাসপোর্ট ভিসা তুলে দিয়ে নিবিড় বন্ধুত্বে স্নাত হচ্ছে প্রতিবেশিরা, ভারতের সাথেও আমাদের এমন সম্পর্কের সুবাতাস বইবে, এ প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের বাঙালি হিসেবে। 
:
তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং জনগণকে যৌক্তিকভাবে মনে রাখতে হবে, ভারত যে কাজ করবে তা অবশ্যই করবে তার নিজ দেশের স্বার্থে। নিজ স্বার্থে কোন কাজ করলেই সে দেশ খারাপ হয়ে যায়না। ভারত, মায়ানমার কিংবা চীন নিজ স্বার্থ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্যে কোন কাজ করে দেবে, এ প্রত্যাশা হাস্যকর বোদ্ধা মানুষের কাছে। তাই বাংলাদেশকে নিতে হবে এমন সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা, যাতে ভারতের এ প্রকল্প থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরাও আমাদের নদীগুলোর সংযোগ করে শীত মৌসুমে পানির চাহিদা মেটাতে পারি। বর্ষা মৌসুমে সংরক্ষণ করতে পারি অতিরিক্ত পানি। এটা না করে ভারত রাষ্ট্র তার বিশাল জনগোষ্ঠীর মঙ্গলের কথা চিন্তা করে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তার কেবল বিরোধিতা করে গেলে, ভারতের সাথে আমাদের কেবল ভুল বোঝাবুঝি বাড়বে। বরং বাস্তবভিত্তিক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে এ প্রকল্প থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা আর সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা। 
:
[প্রবন্ধটি লিখতে সহায়তা নেয়া হয়েছে উইকি, বিবিসি, নেট, ভারত ও বাংলাদেশের বিবিধ পত্রিকা]

ফেসবুকে দেখতে চাইলে :
 

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (Rivers Interlinking Project of India) পর্ব : ১ [ ৪৮ ]

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প (Rivers Interlinking Project of India)
ইতিবাচকতা ভার্সাস নেতিবাচকতা
==========================
=======================

২ পর্বের বড় লেখার প্রথম পর্ব
প্রাক-কথন :
========
ভারতীয় উপদেশের সবচেয়ে জলবেষ্টিত সর্পীল বিণুনী প্রকৃতির দেশ সম্ভবত রাজনৈতিক বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের জীবন মূলত জলকেন্দ্রিক। জলের সাথে যুদ্ধ আর প্রেম করেই টিকে থাকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। জলযুদ্ধও প্রাচিন কাল থেকেই মানুষের মৌলিক প্রপঞ্চের এক অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত এ অঞ্চলে। এ নিয়ে রাজনীতিও কম হয়নি বিশ্বে আর এ উপমহাদেশে। এসব বিস্তারিত আলোচনার আগে নজর দেই এ ভূভাগের মাটি আর মানুষের জীবন কথনে।
:
এ অঞ্চলের সিন্ধু সভ্যতার অন্তিম হরপ্পা পর্যায়ে (১৯০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) হরপ্পাবাসিরা সিন্ধু উপত্যকা ছেড়ে পূর্বদিকে বসতি স্থাপন করতে করতে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব পর্যন্ত চলে আসে বলে মনে করা হয়। যদিও কেউই গঙ্গা পার হয়ে পূর্বতীরে বসতি স্থাপন করেনি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে হরপ্পা সভ্যতার ভেঙে যাওয়ার সময় থেকে ভারতীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রটি সিন্ধু উপত্যকা থেকে সরে চলে আসে গাঙ্গেয় অববাহিকায়। গাঙ্গেয় অববাহিকায় অন্তিম হরপ্পা বসতিতে পুরাতাত্ত্বিক সংস্কৃতি, ইন্দো-আর্য জাতি ও বৈদিক যুগের মধ্যে কোনো সংযোগ থাকলেও থাকতে পারে বলে নৃতাত্ত্বিকগণ মনে করেন। আদি বৈদিক যুগ বা ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা নয়, সিন্ধু ও সরস্বতী নদীই ছিল পবিত্র নদী কিন্তু পরবর্তী তিন বেদে গঙ্গার উপরের অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তারপর মৌর্য থেকে মুঘল সাম্রাজ্য পর্যন্ত অধিকাংশ ভারতীয় সভ্যতারই প্রাণকেন্দ্র ছিল গাঙ্গেয় সমভূমি। 
:
ভূতাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পাতের উপর ভারতীয় পাত নামে একটি ছোট পাতের উপর অবস্থিত। এর গঠনপ্রক্রিয়া ৭৫-কোটি বছর আগে দক্ষিণের বড় মহাদেশ গণ্ডোয়ানার উত্তরমুখে অভিসরণের সময় শুরু হয়। এই গঠনপ্রক্রিয়া চলে ৫০-কোটি বছর ধরে। এরপর উপমহাদেশের পাতটি ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এর ফলে জন্ম হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়ের। উত্থানশীল হিমালয়ের ঠিক দক্ষিণে পূর্বতন সমুদ্রতলে পাত সঞ্চারণের ফলে একটি বিরাট চ্যূতির সৃষ্টি হয়। এই চ্যূতিটি সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলি এবং গঙ্গার আনীত পলিতে ভরাট হয়ে বর্তমান সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির জন্ম দিয়েছে। সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় একটি অগ্রভূমি অববাহিকা।
:
গঙ্গা কেবল পবিত্র নদীই নয়, গঙ্গা বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে দূষিত নদীর একটি। বারাণসীর কাছে এই নদীতে ফেসাল কলিফর্মের পরিমাণ ভারত সরকার নির্ধারিত সীমার চেয়ে একশো গুণ বেশি। গঙ্গাদূষণ শুধুমাত্র গঙ্গাতীরে বসবাসকারী কয়েক কোটি ভারতীয়েরই ক্ষতি করছে না, করছে ১৪০টি মাছের প্রজাতি, ৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয় শুশুকেরও। গঙ্গাদূষণ রোধে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান নামে একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু দূর্নীতি, প্রযুক্তিগত অদক্ষতা, সুষ্ঠু পরিবেশ পরিকল্পনার অভাব, ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বিশ্বাস এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলির অসহযোগিতার কারণে এই প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
:
বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদনদী সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ (Environment) ও প্রতিবেশ (Ecology) সম্পূর্ণভাবে এসকল নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহের উপর নির্ভরশীল। চাষাবাদের জন্য সেচের পানি যোগান, কৃষিভূমিতে নতুন পলি সরবরাহ, অগণিত প্রজাতির মাছের উৎস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখা, বাণিজ্যিক পরিবহন পথ, সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষায় নদনদীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবীকা ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রত ভাবে জগিয়ে আছে এ দেশের নদনদী। গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-মেঘনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীব্যবস্থা ((River Systems) । অসংখ্য উপনদী, শাখানদীসহ গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-মেঘনা নদীব্যবস্থার সম্মিলিত নদী অববাহিকার (River catchment) আয়তন ১৭,২০,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও অধিক। এই বিশাল নদী অববাহিকার মাত্র সাত ভাগের কিছু বেশি এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্গত। অবশিষ্টাংশ ভারত, নেপাল, ভূটান এবং চীনে অবস্থিত। অর্থাৎ ৯০ ভাগের বেশি পানি প্রবাহের উপর বাংলাদেশের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সব সপ্তপদি কর্মকান্ড মাথায় রেখে ভারত সরকার মাথায় নিল আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের। দেখা কি সে প্রকল্প !
:

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প(Rivers Interlinking Project of India)
=================================================

আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের দু’টি প্রধান দিক রয়েছে - যার একটি বলা হয়, “পেনিনসুলা” অংশ এবং অন্যটিকে বলা হয় “হিমালয়ান” অংশ। প্রথম অংশে থাকবে দক্ষিণ ভারতের মহানদি, গোদাভারী, পেন্নার, কৃষ্ণা, কাবেরি ইত্যাদি নদীর মধ্যে সংযোগ সাধনের জন্য ১৬-টি কৃত্রিম খাল তৈরি। আর দ্বিতীয় দিকে - উত্তর হিমালয় নদী উন্নয়ন কার্যক্রম বা (Northern Himalayan River Development Component)-এ থাকবে মূলত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী এবং এগুলোর শাখা নদীতে পানি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম সংরক্ষণাগার তৈরি। এখানে অধিক প্রবাহের সময় পানি ধরে রেখে, শুষ্ক সময়ে সে পানি ব্যবহার করা। এ জন্যে থাকবে ১৪টি কৃত্রিম সংযোগ খাল। ৩০টি সংযোগ খালের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১০-হাজার কিলোমিটার। এরূপ বিশালত্বের কারণে ভারতীয় গণমাধ্যমে একে ‘mother of all projects’ নামেও অভিহিত করা হয়। অনেক গবেষক একে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প হিসেবেও অভিহিত করেছেন। বলা হচ্ছে, কেবল প্রকল্পের নির্মান অংশের জন্যই প্রায় দেড় শ’ থেকে দু’ শ’ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ভারতীয় মিডিয়ায় এই প্রকল্পের জন্য ব্যয়ের যে হিসাব সচরাচর উল্লিখিত হয়েছে তা হলো, ৫,৬০,০০০ কোটি ভারতীয় রূপি। এ প্রকল্পের আওতায় গঙ্গা ও ব্রক্ষপুত্র অববাহিকায় নদীতে বাঁধ দিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে জলাধার তৈরি করা হবে। পাশাপাশি প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটারের মতো খাল খনন করে পূর্ব ভারতের নদীগুলো থেকে জল অপসারণ করে পশ্চিম ভারতের নদীগুলোতে সরাবরাহ করা হবে। এর মাধ্যমে পশ্চিম ভারত ও আশেপাশের রাজ্যগুলোতে জলসংকট দুর হবে বলে ধারণা করছেন ভারতীয় প্লানারগণ।
:
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদীসমূহ সংযুক্তকরার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শুষ্ক মরুময় অঞ্চলগুলোতে পানি সরবরাহ করার একটি মেগা-ইঞ্জিনিয়ারিং উচ্চাভিলাষি ভারতীয় প্রকল্প। এই প্রকল্পের তিনটি অংশ, যথাঃ ১. উত্তরের হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদীসমূহের আন্তঃসংযোগ প্রকল্প, ২. দক্ষিণ ভারতের নদীসমূহের আন্তঃসংযোগ প্রকল্প, এবং ৩. আন্তঃপ্রদেশ নদীসমূহ সংযুক্তকরণ প্রকল্প।
প্রকল্পের হিমালয়ান অংশে হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং তাদের প্রধান প্রধান উপনদীগুলোর পানি ১৪টি লিংক খালের মাধ্যমে সংযুক্ত ও সংগ্রহ করে অসংখ্য বৃহৎ জলাধারে সংরক্ষণ করা হবে এবং উদ্বৃত্ত পানি খালের মাধ্যমে পানি ঘাটতি বা খরাপ্রবণ অংশে নিয়ে যাওয়া হবে। হিমালয়ান নদীসংযোগ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ভারত এই অঞ্চলের অতিরিক্ত ২২মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষাবাদ, ৩০মিলিয়ন কিলোওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীদুটির প্রবাহের উপর একাধিক ড্যাম নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।মানচিত্র-৩ঃ ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প( হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদীসমূহ সংযুক্তকরণ প্রকল্প)
:
ভারতে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হলো ‘ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ (এনডব্লিউডিএ)। এই সংস্থার মতে ভারত তিনটি বিবেচনা থেকে এই প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে :-
:
ক. ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৭০-কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা যোগানের লক্ষ্যে বাড়তি জমিকে সেচের আওতায় আনা; 

খ. গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বাৎসরিক বন্যার হাত থেকে আসাম, পশ্চিমবাংলা, বিহার ও উত্তরপ্রদেশকে রক্ষা করা; এবং 

গ. রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি প্রদেশের খরা ও মরুপ্রবণ এলাকার সবুজায়ন।
:
ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প অনুসারে, ভারতের উত্তর–পূর্বদিকের হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর “বাড়তি” পানি বিভিন্ন সংযোগ খালের মাধ্যমে ভারতের দক্ষিণের শুষ্ক এলাকার নদীগুলোতে সরবরাহ করে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হবে। ভৌগলিক ভাবে এই প্রকল্পকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে– হিমালয় অঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল বা পেনিনসুলার অঞ্চল। হিমালয় অঞ্চল থেকে মোট ৬ হাজার ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যের ১৪টি খাল ও ১৬টি জলাধার ব্যবহার করে ১৪১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার(বিসিএম) পানি দক্ষিণের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং দক্ষিণের বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৪,৭৭৭ কি,মি দৈর্ঘ্যের আরো ১৬টি খাল ও ৫৮টি জলাধার ব্যাবহার করে ৩৩ বিসিএম পানি সংগ্রহের মাধ্যমে হিমালয় ও দক্ষিণাঞ্চল মিলিয়ে মোট ১৭৪.৩ বিসিএম পরিমাণ পানি স্থানান্তর করা হবে। আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে ভারতের দক্ষিণে স্থানান্তরের জন্য নির্ধারিত মোট ১৪১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার(বিসিএম) পানির মধ্যে ৪৩ বিসিএম পানি নিয়ে যাওয়া হবে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে যে নদীটি শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৮০% পানির উৎস। এ কাজে ব্যাবহার করা হবে মানস–সংকোশ–তিস্তা–গঙ্গা সংযোগ খাল যার একটি বিকল্প হলো ব্রহ্মপুত্রের জোগিঘোপা–সংকোশ–তিস্তা–গঙ্গা সংযোগ খাল। এই সংযোগ খাল গঙ্গার ফারক্কা ব্যারেজের ৬০ কি.মি উজানে গঙ্গার সাথে মিলিত হবে যা থেকে ১৫ বিসিএম পানি ফারক্কা ব্যারেজের দিকে প্রবাহিত করে বাকি পানি বিভিন্ন সংযোগ খালের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে সরবরাহ করা হবে। পানি স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি নিম্নোক্ত উপায়ে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছে ভারত:
:
১. ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদী মানস নদীর উপর ভারত–ভুটান সীমান্তের প্রায় ৫ কি.মি উজানে ৮৭৫০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার(এমসিএম) পানি ধারণক্ষম জলাধার সহ একটি ড্যাম নির্মাণ।
:
২. ভুটানে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদের আরেকটি উপনদী সংকোশ নদীর উপর ভারত–ভূটান সীমান্তের ১২ কিমি উজানে ২৫৩ মি উচ্চতার ৪৯৩০ এমসিএম ধারণ ক্ষমতার জলাধার সহ আরেকটি ড্যাম নির্মাণ। এবং সংকোশ ড্যামের ১১ কিমি ভাটিতে সংকোশ ব্যারেজ নির্মাণ।
:
৩. পানি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে গঙ্গায় নেয়ার জন্য মোট ৪৫৭ কিমি দীর্ঘ, ১০ মিটার গভীরতা ও ১:২০০০০ ঢাল সম্পন্ন মানস–সংকোশ–তিস্তা–গঙ্গা সংযোগ খাল (লিংক–১০) নির্মাণ করা। এই প্রক্রিয়ায় পানি মানস ও সাংকোশ নদী থেকে ব্রহ্মপুত্রে পৌছানোর আগেই তিস্তা হয়ে গঙ্গায় পাঠিয়ে দেয়া হবে।
:
বিজ্ঞানসম্মত উপাত্তের অভাবে তাত্ত্বিক সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও, এই প্রকল্প ধারণাটি বিশেষ বেগবান হয় ১৯৯৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে এনডিএ জোট দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণের পর। রাজস্থান, গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুর মতো হিন্দু প্রধান ও খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে ভোট পাওয়ার জন্য বিজেপি এই প্রকল্পকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের জন্য তারা যে টাস্কফোর্স গঠন করে খুব সচেতনভাবে তার প্রধান করা হয় শিবসেনা নেতা সুরেশ প্রভুকে। River-Politics নামে পরিচিত তথা ভারতে বহুল আলোচিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের কার্যক্রমে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটেছে ২০১৫ সনে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সম্প্রতি। যার প্রথম ধাপ হিসেবে কেন (Ken) ও বেতোয়া (Betwa) নদীর মাঝে সংযোগকারী কৃত্রিম খাল তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে শিগগির। উল্লেখ্য, মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ জুড়ে প্রবাহিত কেন ও বেতোয়া নদী উভয়েই যমুনায় মিশেছে, আর যমুনা আবার মিশেছে গঙ্গা তথা পদ্মায়। 
:
পুরোপুরি কংক্রীটে তৈরি কেন-বেতোয়া নদী সংযোগ খালটি হবে প্রস্তাবিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের ৩০টি পরিকল্পিত খালের প্রথমটি - যার দৈর্ঘ্য ৩২৩.৪৫ কিলোমিটার। তবে এই নির্মাণ উদ্যোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো মধ্যপ্রদেশের সাত্তারপুর-পান্না জেলার সীমান্তে প্রকল্পের মধ্যে ৭৩.৮০ মিটার উচু একটি ড্যাম [‘দাউদান’ (Daudhan) নামে পরিচিত] গড়ে তোলা হবে। যার দু’ স্থানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের দুটি কেন্দ্র থাকবে। কেন-বেতোয়া সংযোগ খাল থেকে ভারত মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের ৪.৯৭ লাখ হেক্টর জমিকে নতুন করে সেচের আওতায় আনবে বলে পরিকল্পনা করছে। যেসব জেলায় সংযোগ খাল থেকে সেচের পানি যাবে তার মধ্যে রয়েছে - মধ্যপ্রদেশের সাত্তারপুর, টিক্কাগড়, পান্না, রাচি, বিদিশা এবং উত্তর প্রদেশের ঝাশি ও হামিরপুর। সেচ ছাড়াও বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকায় কেন-বেতোয়া প্রকল্প বিশেষজ্ঞ পরিমন্ডলে ‘সেচসহ বিদ্যুত প্রকল্প’ হিসেবেই পরিচিত এখন।
:
ভারতের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর মধ্যে পাঞ্জাব অন্যতম। এরই মধ্যে রাজ্যটির ভূ-উপরিভাগে জলের রিজার্ভ শেষ হয়ে এসেছে। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে রাজ্যটির ৮০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ জলের স্তর প্রতিবছর এক মিটার করে নীচে নেমে যাচ্ছে। আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় সব মিলিয়ে ৩০টি সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যার মধ্যে ১৬টি পড়েছে দ্বিপাঞ্চলে আর ১৪টি পড়েছে হিমালয় উপত্যকায়। এর মাধ্যমে ১৭০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল সঞ্চালন করা হবে। এছাড়াও আরো বেশ কিছু সংযোগ প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে যেগুলো রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। সম্প্রতি বাংলা সফরকালে “হিমালয় অঞ্চলের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে না নেওয়ার” বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। যা ধন্যবাদযোগ্য মনে করি একজন বাঙলাদেশি হিসেবে।
:
[প্রবন্ধটি লিখতে সহায়তা নেয়া হয়েছে উইকি, বিবিসি, নেট, ভারত ও বাংলাদেশের বিবিধ পত্রিকা থেকে]


ফেসবুক লিংক দেখুন :



শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ-ভারতের শীত মৌসুমে পানি সমস্যার বিশ্লেষণ # ৪৭



বাংলাদেশ-ভারতর শীত মৌসুমে পানি সমস্যা :
এদেশের নদীগুলো শুকানোর জন্যে কি সত্যিই ‘ফারাক্কা’ দায়ী?
ভারতকে কেন খামোখা অযৌক্তিক দোষারোপ করা হয়?

নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মত বিস্তৃত নদীগুলোর দু’তীরের মানুষের জীবন আসলে নদীকেন্দ্রীক। প্রধানত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান এই নদীগুলোর অধিকাংশই এদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। বলা হয়ে থাকে কমপক্ষে ৫৪-টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও শাখানদী-উপনদী নিয়ে তার সংখ্যা আসলে কয়েক’শর মত। নদী নির্ভরশীল বাংলাদেশের এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, শুকনো মৌসুমে ‘পানির স্বল্পতা’ এবং বর্ষা মৌসুমে ‘জলাধিক্য’ ও ‘নদীভাঙন’। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সরকারী-বেসরকারী নানা পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারের কারণে বিশ্বাস জন্মে যে যে, ‘‘শুকেনো মৌসুমে (শীতে) ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে এদেশের নদীগুলো শুকিয়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে, বিপরীত দিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত ‘তার পানি’ বাংলাদেশের দিকে ‘ঠেলে’ দিয়ে ভাটির এ দেশটিকে ডুবিয়ে মারছে’’। এ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বেশেষে কোটি কোটি মানুষ উপরে বর্ণিত কথাগুলো বিশ্বাস করার কারণে, তাদের বর্তমানে দুর্ভোগের জন্যে ‘ভারত’কে দায়ী করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। নদীসৃষ্ট আমাদের বর্ণিত দুর্ভোগ্যের জন্যে প্রকৃতপক্ষে ‘ফারাক্কা’ তথা ‘ভারত’ সত্যি কি দায়ী? না কেবলমাত্র প্রতিবেশী একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা টিকিয়ে রাখার এটি একটি ষড়যন্ত্র? বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে।

এদেশে প্রবাহমান নদীগুলোর প্রায় সবগুলোর উৎস ‘উজান’ তথা ভারতে এবং মোহনা তথা ‘মিলনস্থল’ বাংলাদেশে। যেমন গঙ্গার উৎস ‘গঙ্গোত্রী হিমবাহ’ এবং ব্রহ্মপুত্রের উৎস ‘মানস সরোবরে’। নদীর ধর্মানুযায়ী নদী তার প্রবাহিত গতিপথে সকল প্রকার বাঁধা ও অসমতা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে প্রবাহিত হয়। সৃষ্ট সর্পিল বাঁকের কারণে ক্ষয়ক্রিয়া তথা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। প্রথাগতভাবে নদীগুলোর জীবনকাল ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। উৎসে নদীগুলো ‘যৌবন’দীপ্ত তথা খরস্রোতা থাকলেও, বাংলাদেশে নদীগুলো মূলত তারুণ্য-যৌবন হারিয়ে ‘পরিণত’ বয়সে মন্থর ও বিসর্পিল বা বিনুনি আকতি নিয়ে এদেশে প্রবেশ করে এবং অনেক নদী কেবল ‘বার্ধক্যে’ এদেশে প্রবেশ করে বিধায় নাব্যতা হারায়। পলি ও মিহি বালুতে গঠিত নদীতীর, সাম্প্রতিক মজুতকৃত তীরের নরম পদার্থসমূহ ভাঙনের পক্ষে খুবই সংবেদনশীল। তা ছাড়া এ অঞ্চল গঠনগত প্রকৃতি তথা নদীগুলো দক্ষিণমুখী, সর্পিল, চরোৎপাদী বা বিনুনি, সরলাকার, সূক্ষ্ম বালুকণাময় তলদেশ, নরম পলল গঠিত ভূমি, পরিমিত ঢাল, ভাঙনপ্রবণ তীর ও পরিবর্তনশীল নদীখাতজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে, উজান থেকে নদী ভাঙনজাত প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন মাটি-পলি বা উপজাত পদার্থ ‘ভাটি’তে নিয়ে এসে নতুন চরের সৃষ্টি করে, যে কারণে নদীগুলো চর সৃষ্ট কারণে ভরাট হয় এবং বর্ষায় পানি প্রবাহ উপচে অকাল বন্যার সৃষ্টি করে। এগুলো মূলত হয় নদীর সঞ্চয়কাজের ফলে বদ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর ও পলিজাত উপভূমি সৃষ্টি হয়ে। এই নদীগুলো কেবল ভারত থেকে ২.৪ বিলিয়ন টন নরম মাটি-পলিই নিয়ে আসেনা, বর্ষামৌসুমে প্রবল জলস্রোতে অনেক ‘নুড়িপাথর’ বহন করে, যা বাংলাদেশে সিলেটসহ বেশ ক’টি জেলায় সংগৃহীত হয় এবং এদেশের নির্মাণ শিল্পে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে ভারতের নদী প্রবাহ আমাদের উপকারও করে বটে।

প্রাকৃতিক কারণে ১৭৮৭ সনে ‘তিস্তা’র মধ্যে বিনুনি প্রকৃতি, প্রচরণ ও বিপুল বালুস্রোত প্রবাহের কারণে ‘আত্রা’ই নদীমুখে জমা হয়ে, তিসত্মার প্রবাহ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে ‘ঘাঘট’ নদীর দিকে নবরূপে প্রবাহিত হয়। অবার ধরলা বর্ষাকালে প্রায় ‘যৌবনপ্রাপ্ত’ নদীশ্রেণিভুক্ত হলেও, শুকনো মৌসুমে এটি মৃতপ্রায় বিনুনি প্রকৃতিতে পরিণত হয়। ১৭৮৭ সালে অসামের প্রবল বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের নদী প্রবাহ তথা ধারা পরিবর্তিত হয়ে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র’ মৃতপ্রায় নদীতে রূপান্তর হয়। এভাবে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মেই এ অঞ্চলের নদীগুলো তাদের পথ পরিক্রমা খুঁজে নেয়।

এ অঞ্চলের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গ্রীষ্মকালে প্রবল বৃষ্টিপাত ও শুকনো মৌসুমে বিরল বৃষ্টি। গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু একই সময়ে হওয়াতে হিমালয়ের বরফগলা পানি ও প্রবল বৃষ্টিপাত মিলে ভাটি অঞ্চলে প্রবল বেগে নেমে এসে বন্যার সৃষ্টি করে। বিপরীত দিকে শুষ্ক মৌসুমে শীতকাল থাকাতে হিমালয় অঞ্চলে বরফ জমাট বাঁধে এবং বৃষ্টি বিরল হওয়াতে জলপ্রবাহ হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে উজানের নদী সম্পৃক্ত মানুষগুলো তাদের জল চাহিদা পুরণের জন্যে ভাটিতে অবাধ জলপ্রবাহে কৃত্রিম বাঁধা সৃষ্টি করে। এরূপই একটি বাঁধা হচ্ছে ‘ফারাক্কা বাঁধ’, যা বাংলাদেশ সীমামেত্মর ১৮ কিমি উজানে ভারত নির্মাণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ও সরকারী তথ্য বিশেøষণে দেখা যায়, ফারাক্কা বঁাধের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও কিংবা বাঁধ নির্মাণের অনেক আগেই গত ১০০-বছরে রাজশাহীর ১০টি নদীর মধ্যে ৯টিই এখন মৃত নদী। যশোরের ৮টি নদী, কুড়িগ্রামের ১২টি নদী মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ৬টি নদী সংস্কারের অভাবে ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। গাইবান্ধার তিনটি প্রধান নদীতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হচ্ছে। পঞ্চগড়ে প্রবাহিত ২০টি নদীর মধ্যে ১০টি নদী, রংপুর জেলার ১০টি নদীই ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। দিনাজপুর জেলার মৃত নদীর তালিকায় রয়েছে তিনটি নদী। কুমিল্লার তিনটি নদীর অস্তিত আর খঁুজে পাওয়া যাবে না। বৃহত্তর বরিশাল জেলা থেকে হারিয়ে গেছে ৬টি নদী। টাঙ্গাইল থেকে তিনটি, ফরিদপুর থেকে তিনটি, নড়াইল থেকে ৪টি নদী, কুড়িগ্রাম থেকে ১০টি, গাইবান্ধা থেকে তিনটি, মানিকগঞ্জ থেকে ২টি, খুলনার তিনটি, ঝিনাইদহের ২টি, বগুড়ার ৫টি, পাবনার ২টি, নেত্রকোনার ১২টি, চঁাপাইনবাবগঞ্জের ২টি এবং সুনামগঞ্জের ১০টি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক কারণে। এছাড়া মাদারীপুর, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, শরিয়তপুর থেকেও একাধিক নদী বিলুপ্ত হয়েছে একই কারণে। এমনকি বৃহত্তর ঢাকা জেলার ওপর দিয়ে এক সময় ৩১টি নদ-নদী প্রবাহিত হতো। এর মধ্যে ১২টি নদী মজে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বর্ণিত কারণে।

বিগত ১০০ বছরে আমাদের প্রায় ২৪,১৪০ কিমি নদীপথের আঁকাবাঁকা সর্পিল চমৎকার নামধারী ৭০০ জালিকার মত নদীপ্রবাহের অনেক নদী এখন মৃত কিংবা মৃতপ্রায়। অসিত্মত্বলোপ বা বিলুপ্তপ্রায় এ নদীগুলো হচ্ছেঃ ডাহুক, তলমা, নাগর, কোকিল, টাংগস, ঘাঘট, ঢেপা, আত্রাই, বুড়িতিসত্মা, যমুনেশ্বরী, ত্রিমোহনী, ধরলা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, জিজিরাম, করতোয়া, ছোট যমুনা, শিব, মহানন্দা, পাগলা, বারানাই, ভোগাই, নিতাই, কংস, সোমেশ্বরী, ধনু, পিয়াইন, বানার, কুমার, মধুমতি, নবগঙ্গা, ফটকি, চিত্রা, ভৈরব, কপোতাক্ষ, গোমতী, স্বাতি, খারভাজা, আখির, খারখরিয়া, গদাধর, সনকোশ, নোয়াডিহিং, কাপিলি, টাঙ্গন, কোরাম, বড়াল, জলঢাকা, কল্যাণী, হুরাসাগর, তালান, লক্ষ্যা, ভুৃবনেশ্বরী, ইলশামারী, আইমন, সুতিয়া, বোথাই, নিতারী, পানকুরা, ধানু, মানস, কালনি, হরি, রক্তি, তিতাস, খেরু, কাকড়ি, জাঙ্গালিয়া, বুড়িগাঙ, বিজলী, ইছামতি, জলাঙ্গি, চন্দনা, পানগুবি, কবা, পাংগানি, গড়াই, পাংল, আত্রাই, গলাঙ্গী, শীলা, কাগীবাগ, চন্দনা, পটুয়া, ধানসিঁড়ি, নলবিটি, কালিদা, বুড়া গৌরাঙ্গ, হংসরাগ, ডাংমারি, লতাবেড়ি, সাতনলা ইত্যাদি। উপর্যুক্ত নদীগুলোর বিলুপ্তি কিংবা গথিপথ বার্ধক্যে পরিণত হওয়াকে কি ‘ভারতের কারসাজি’ বলবো? এভাবে আমরা গত ১০০ বছরে হারিয়ে ফেলেছি ১০০-এর বেশি নদী। হারিয়ে যাওয়া এই নদীগুলোর জন্যে কিন্তু ফারাক্কাকে দায়ী করার কোন উপায় নেই। এর অধিকাংশ নদীর সঙ্গে ফারাক্কার কোন যোগসূত্র ছিলনা কিংবা এখনো নেই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের নদীর গঠনগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নাব্যতা হারায়, ভাঙন ও চর সৃষ্টি হয় এবং বর্ষায় প্রবল জলপ্রবাহের কারণে বন্যা এবং শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে কম জল প্রবাহের কারণে সকল নদীতে (কেবল গঙ্গায় নয়) নাব্যতা সংকটের সৃষ্টি হয়। হ্যা, যদিও শুকনো সিজনে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে গঙ্গা তথা পদ্মায় কম জল আসে এবং এ প্রেক্ষিতে নাব্যতা, লবণাক্ততা, নৌপরিবহণ, কৃষি ও মংস্য প্রজননে সমস্যা দেখা দেয় কিন্তু বাংলাদেশের পদ্মাসহ অন্যান্য উল্লিখিত নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের জন্যে এটিই কিন্তু একমাত্র কারণ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ভূপ্রাকৃতিক কারণ।

তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, গঙ্গার পানি আমাদের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ‘গঙ্গার তীরবর্তী’ ভারতের নাগরিকদেরও। যারা সড়কপথে ভুটান বা নেপাল ভ্রমণ করেছেন, তারা দেখেছেন ‘জলপাইগুড়ি’ বা ‘কুচবিহার’ জেলার, এমনকি ‘ভুটানের ফুল্টসলিং’ এলাকার শুকনো নদীগুলো কিভাবে ২-৩ ইঞ্চি পানি নিয়ে চিক চিক করছে, সেতুগুলো ঠায় চরের উপর দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ পায়ে হেটে নদী পার হচ্ছে। ঐ অঞ্চলের নৌকা, মাছশূন্য নদীগুলোর তুলনায় ‘ভাটির দেশ’ হিসেবে আমরা কিছুটা ভাল অবস্থানে নই কি?
আন্তর্জাতিক এমন কোন নদীবণ্টন আইন বা প্রটোকল নেই যাতে ভারত ও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং কোন আইনেই ভারত থেকে জোর করে পানি আনা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে, বাস্তবতায় ফিরে এসে অযথা নদী সংকটের জন্যে ভারতকে একতরফা দায়ী না করে, সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে যৌথভাবে ড্রেজিং, জলাধার নির্মাণ, ভাঙন প্রতিরোধ, গথিপথ সহজীকরণ ইত্যাদির মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও উভয় দেশের নদীনির্ভর মানুষকে বঁাচানোর জন্য যৌথভাবে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় মানুষই বাঁচতে পারে।

[ সঙ্গে প্রদত্ত গঙ্গার মানচিত্রে বোঝা যাবে, গঙ্গার প্রবাহের প্রতি বাংলাদেশে চেয়ে কত বেশি ভারতীয় মানুষ নির্ভরশীল, এবং তার গতিপথ ভারতে কত বিস্তৃত! ]